আই. ডাব্লিউ. টি. এ ফেরিটা দাউদকান্দি পৌঁছুল দেড়টার সময়। তারপর একটানা পথ। মেঘবিহীন খর-বৈশাখের দুপুর। অসহ্য গরম বাতাস আগুনের হল্কার মত জ্বালা ধরায় চোখে-মুখে। এমন দিনে এত বেলায় শখ করে কেউ ঢাকা থেকে চিটাগাং যায় না। কেউ নিতান্ত ঠেকায় পড়লে ভোর বেলার ফেরিতে পার হয়ে দেড়টা দুটোর মধ্যে পৌঁছে যায় চট্টগ্রামে। তাই মাসুদ রানার সহযাত্রী অন্য একটা গাড়িও নেই যে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দূর পথ চলার একঘেয়েমি কাটাবে। মাঝে মাঝে কেবল এক আধটা বাস বা ট্রাক আসছে সামনে থেকে—একরাশ ধুলো উড়িয়ে চলে যাচ্ছে দাউদকান্দির দিকে। রাস্তায় লোকজনের চলাচল এত কম যে মাঝে মাঝে হঠাৎ ধোকা লাগে: কে আমি, কোথায় চলেছি! গাড়ির ভিতরের ভ্যাপসা গরমে মাথাটা ঘুরে উঠতে চায়।

কুমিল্লায় পৌঁছে ট্যাঙ্ক ভর্তি করে পেট্রল নিয়ে নিল মাসুদ রানা। গাড়ি থামালেই বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে রানার দৃঢ় দুই বাহুর লোমকুপগুলো ঘিরে, জুলফির ভিতর দিয়ে ঘাম গড়িয়ে নীচে নামতে আরম্ভ করে, আর সুড়সুড়ি লাগে। আবার ষাট—পঁয়ষট্টি—সত্তর—আশিতে ওঠে স্পীড মিটারের কাঁটা ৪০ মাইলের গড়পড়তা ঠিক রাখতে। তখন নোনতা ঘামে-ভেজা শরীরটা শুকিয়ে চড়চড় করে।

ঝির ঝির করে এয়ার কুলড ইঞ্জিনের একটানা একঘেয়ে শব্দ, আর গাড়ির নীচ দিয়ে কার্পেটের মত কালো পিচের রাস্তাটার অনবরত পিছনে সরে যাওয়া। মাঝে মাঝে এক আধটা শিরীষ কি অশ্বথ গাছ ঝাঁই করে চলে যাচ্ছে পিছনে। রাস্তার পাশে নিচু জায়গায় যেখানে অল্পস্বল্প পানি আছে, সেখানে কিছু সাদা বক ধৈর্যের সঙ্গে মাছের অপেক্ষায় এক পায়ে দাঁড়ানো।

রানা ভাবছে, যদি আসল ঘটনা প্রতিপক্ষ জেনে গিয়ে থাকে তবে বসন্তপুর বা চোদ্দগ্রামে গিয়ে কী দেখবে সে। হয়ত ইপিআর বা মেয়েটির কোনও চিহ্নই পাওয়া যাবে না রাস্তায়। এমনও হতে পারে সেনকে বন্দি করার পাল্টা জবাব হিসেবে ওকে ধরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করবে সৈন্যরা। যা হবার তাই হবে—মাথা থেকে এসব বাজে চিন্তা তাড়াবার চেষ্টা করল রানা। খুব সম্ভব এত শিগগির ওরা টের পায়নি সুবীর সেনের ব্যাপার। কিন্তু নিজের অজান্তেই আবার ভাবতে লাগল ও, যদি সৈন্যরা কোনও রকম সিগনাল বা কোডওয়ার্ড আশা করে ওর কাছ থেকে পরিচিতি হিসেবে, তখন কী করবে ও? তখনই তো হাতে নাতে ধরা পড়ে যাবে ও। সে দেখা যাবে ’খন। আবার চিন্তাটাকে দূর করে দিল রানা। কোড থাকলে জানাত চিঠিতে।

এবার পথের দিকে মন দিল ও। ভাগ্যিস চিটাগাং-ফেনী-কুমিল্লা-দাউদকান্দি বাস সার্ভিস রয়েছে; তাই মাঝে মাঝে ‘পথের সাথী’, ‘গ্রীন অ্যারো’, ‘টাইগার এক্সপ্রেস’ বা ‘দুল্‌দুল’ লেখা এক আধটা বাসের দেখা পাওয়া যায়, আর হাফ ছেড়ে বাঁচে রানা।

আচ্ছা, মেয়েটা দেখতে কেমন হতে পারে? স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একই ঘরে সিট রিজার্ভ করবার অর্থ কি? সুবীর সেনের প্রশংসনীয় কাজের পুরস্কার হিসেবে আসছে না তো মেয়েটা!—আপন মনেই মুচকি হাসল রানা।

হঠাৎ একটা লোহার রড, বোঝাই ট্রাক সামনে থেকে এসে ঘাড়ের উপর উঠবার উপক্রম করল রানার। বেশ কিছুটা দূর থেকেই স্পীড কমিয়ে তিরিশে নিয়ে এসেছিল রানা, কিন্তু ভাবতেও পারেনি যে ট্রাক ড্রাইভারটা হারামীপনা করে সবটা রাস্তা জুড়ে ফুল স্পীডে আসবে–জায়গা ছাড়বে না একটুও। এক হেঁচকা টানে স্টিয়ারিংটা ঘুরিয়ে ঘাসের উপর নেমে এল রানা। ডান পা-টা এক্সিলারেটর ছেড়ে হাইড্রলিক ব্রেকের উপর তিনটে মৃদু চাপ দিল। গাড়িটা ততক্ষণে কয়েকটা ছোট-বড় গর্তে পড়ে পদ্মার ঢেউয়ের মাথায় ডিঙি নৌকার মত নাচানাচি আরম্ভ করেছে। কিছুদূর গিয়ে থেমে গেল গাড়ি। ট্রাক ততক্ষণে বহুদূর চলে গেছে। অসম্ভব রাগ হলো রানার। নির্জন রাস্তায় একা গাড়িতে বসে ট্রাক ড্রাইভারের উদ্দেশে অশ্রাব্য অকথ্য ভাষায় সজোরে গালাগালি করল ও কিছুক্ষণ ইংরেজি বাংলা উর্দু মিশিয়ে। তারপর সন্তুষ্টচিত্তে আবার স্টার্ট দিল গাড়িতে। চোদ্দগ্রাম ছাড়িয়ে গেল রানা, তবু কারও দেখা নেই।

ঠিক তিনটে সাতচল্লিশে রানা দেখল একটা ওয়্যারলেস ফিট করা উইলিজ্ জিপ আসছে দূর থেকে। একটু কাছে আসতেই আরোহীদের স্পষ্ট দেখা গেল। কয়েকজন মিলিটারি পোশাক পরা লোক এবং একজন মহিলা বসে আছে গাড়িতে। এক মুহূর্তে প্রস্তুত হয়ে নিল রানা। টী-শার্টের উপরের দিকের দুটো বোতাম খোলাই ছিল–আরেকটা খুলে দিল ও, যাতে প্রয়োজনের সময় পিস্তল বের করতে কোনও অসুবিধে না হয়। বাম বাহু দিয়ে পাজরের সঙ্গে চেপে স্প্রিং লোডেড হোলস্টারটার স্পর্শ অনুভব করল ও একবার। গজ পনেরো থাকতেই নাম্বার প্লেট দেখে ব্রেক কষল জিপ। ড্রাইভার হাত বের করে রানাকে থামবার ইঙ্গিত করল। রানাও ব্রেক করে ঠিক জিপের পাশে থামাল ওর ফোক্সওয়াগেন।

রানাকে দেখেই মিষ্টি হেসে মেয়েটি বলল, ‘নমস্কার, সুবীর বাবু।’

‘নমস্কার।’ সদ্য ফোঁটা শিশির মাখা ফুলের মত প্রাণবন্ত এবং সুন্দরী মেয়েটির দিকে এক মুহূর্ত অবাক চোখে চেয়ে উত্তর দিল রানা।

চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স হবে মেয়েটির। উন্মুক্ত ক্ষীণ কটি। কপালে কুমকুমের লাল টিপ। ঠোঁটে হাল্কা গোলাপী লিপস্টিক। বড় করে একটা বিড়ে খোঁপা বেঁধেছে মাথায়—তাতে সুন্দর করে প্লাস্টিকের কটা রজনীগন্ধা গোঁজা। সরু চেনের সঙ্গে বড় একটা লাল রুবি বসানো লকেট ঝুলছে বুকের উপর। ডান হাতে এক গাছি সোনার চুড়ি, বাঁ হাতে ছোট্ট একটা রোলগোল্ডের সাইমা ঘড়ি। ফরসা গায়ের রঙ তার আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে স্বাস্থ্যের প্রাচুর্যে। একহারা লম্বা গড়ন অটুট স্বাস্থ্যের লাবণ্যে কমনীয়। এমন আকর্ষণীয় চেহারা সহজে চোখে পড়ে না। আরও উগ্র দেখাচ্ছে ওকে ঝাঝাল লাল আর হলুদে মেশানো কাতান শাড়িটা আঁটসাঁট করে পেঁচিয়ে পরায়। সুগোল, সুপরিপুষ্ট স্তন যুগল সগর্বে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে। সুগঠিত দেহের প্রতিটা নিটোল অঙ্গ, প্রতিটা খাঁজ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে নিপুণ হাতে এঁটে পরা শাড়ির নীচ থেকে। সত্যিই এমন চেহারা সহজে চোখে পড়ে না।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সশব্দে দরজা বন্ধ করল রানা। জিপের ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এসে হ্যাণ্ডশেক করল আর্মি অফিসার রানার সঙ্গে। বলল, ‘দিস্ ইজ ক্যাপ্টেন মোহন রাও। হাউড়ু ইয়ু ডু, মি. সেন?’

‘হাউ ডু ইয়ু ডু,’ স্বাভাবিক গাম্ভীর্যের সঙ্গেই উত্তর দিল রানা।

‘কয় প্যাকেট লাগবে আপনার, মি. সেন?’ প্রশ্ন করল মোহন রাও।

‘চারটে।’

‘বেশ, গাড়ির পেছনের সিটে তুলে দিচ্ছি প্যাকেটগুলো।’

‘না। সামনের বুটে রাখতে বলুন।’

ব্যস, আর প্রয়োজন হলো না। এটুকুতেই বুঝে নিল ক্যাপ্টেন যা বুঝবার। জোরে রানার হাতটা আবার বার কয়েক ঝাঁকিয়ে চোখে-মুখে একটা আবছা ইশারা করল সে।

ততক্ষণে মেয়েটি এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। একটু মিষ্টি গন্ধ। মৃদু রিনি-ঠিনি চুড়ির শব্দ। আঁচল উড়ছে বাতাসে।

‘বাব্বা, কী অসম্ভব গরম!’

‘আপনি গাড়িতে গিয়ে বসুন না।’ যেন কতকালের চেনা, এমনিভাবে বলল রানা। মেয়েটির দ্বারা এই মুহূর্তে কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা নেই—লক্ষ্য রাখতে হবে সিপাই তিনজন আর ক্যাপ্টেনটার দিকে।

গাড়িতে গিয়ে বসল মেয়েটা। তারপর বাঁ হাতে লিভারে টান দিয়ে সামনের বনেটটা খুলে দিল। ফোক্সওয়াগেন গাড়ি সম্বন্ধে মেয়েটির পরিষ্কার ধারণা আছে বোঝা গেল।

হিন্দীতে জিপের লোকগুলোকে কিছু বলল ক্যাপ্টেন। সশব্দে লাফিয়ে নামল গাড়ি থেকে ইপিআর-এর ইউনিফরম পরা তিনজন সৈন্য। বাঙালী বলে মনে হলো না। বোধহয় দাড়ি কামানো শিখ হবে। বিনা বাক্যব্যয়ে জুতোর বাক্সের চাইতে সামান্য বড় তিনটে প্যাকেট খুব যত্নের সঙ্গে এনে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখল সেপাইরা বুটের মধ্যে। বাক্সগুলো পাতলা কেরোসিন কাঠের। বাইরে থেকে স্টিলের পাত দিয়ে জড়িয়ে শক্ত করে বাঁধা। দু’একটা খড়কুটো বেরিয়ে আছে। প্যাকেটের গায়ের কোনও ফাঁক দিয়ে। গায়ে লেবেল বা কোনও রকম চিহ্ন নেই। ভিতরে কী আছে ঠিক বুঝতে পারল না রানা, কিন্তু বয়ে আনার ধরণ দেখে মনে হলো ছোট হলেও যথেষ্ট ভারী প্যাকেটগুলো। একজন ফিরে গিয়ে আর একটা অপেক্ষাকৃত ছোট প্যাকেট এনে রাখল বুটের ভিতর, তারপর বনেটটা নামিয়ে দিতেই অটোমেটিক লক হয়ে গেল সেটা।

বাকি দুজন ততক্ষণে মেয়েটির একটা সুটকেস তুলে দিয়েছে গাড়ির পিছনের সিটে। এদের মনে কোনও রকম সন্দেহের উদ্রেক হয়নি দেখে আশ্বস্ত হলো রানা। পিসিআই-এর নিপুণ কাজের জন্যে গর্ব অনুভব করল সে।

ক্যাপ্টেন মোহন রাও ড্রাইভিং সিটে উঠে বসে হাতের ইশারায় কাছে ডাকল রানাকে। রানা কাছে যেতেই নিচু গলায় মেয়েটিকে ইঙ্গিত করে অশ্লীল একটা রসিকতা করল সে; তারপর বলল, ‘যান মশাই, প্রাণ ভরে মৌজ করুন গিয়ে।’

এই রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে এসব নোংরা রসিকতা শুনে পিত্তি জ্বলে গেল রানার। ঠাঁই করে এক চড় বসিয়ে দিতে ইচ্ছে করল ব্যাটার ফোলা গালের উপর। তবু চেষ্টাকৃত দেঁতো হাসি হাসল একটু।

হঠাৎ পিছন থেকে খটাশ করে জোরে একটা আওয়াজ হতেই চমকে ফিরে দাঁড়াল রানা। দেখল তিনজন একসঙ্গে বুট ঠুকে স্যালিয়ুট করছে ওকে। রানার ডান হাতটা দ্রুত চলে এসেছিল পিস্তলের কাছে–এক সেকেণ্ডে সামলে নিয়ে সেও হাত তুলে ভারতীয় কায়দায় প্রত্যাভিবাদন করল। পরমুহূর্তেই এক লাফে জিপের পিছনে উঠে বসল তিন সেপাই তিনটে বানরের মত, এবং সঙ্গে সঙ্গে সাঁ করে চলে গেল জিপটা যেদিকে যাচ্ছিল সেদিকেই।

বিলীয়মান গাড়িটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল রানা। দিনে দুপুরে ভোজবাজীর মতই ঘটে গেল যেন ঘটনাগুলো। এই কয়মিনিট আগে গ্রীষ্মের প্রখর রোদের মধ্যে উত্তপ্ত রাস্তার উপর সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে একা গাড়ি চালাচ্ছিল সে। হঠাৎ কোথাকার এক জিপ এসে তার সমস্ত উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিরসন করে অজানা অচেনা এক সুন্দরী মেয়েকে তুলে দিয়ে গেল তার হাতে, যেন জাদুমন্ত্রের বলে। এখন আর সে জিপের কোনও চিহ্নও নেই—রয়েছে কেবল সে আর মেয়েটি।

‘হাঁ করে কী দেখছেন, সুবীর বাবু! এদিকে গরমে যে ঘেমে নেয়ে উঠলাম।’ জড়তাহীন পরিষ্কার সুরেলা গলা।

গাড়িতে ঢুকেই একটা সুগন্ধ পেল রানা। শ্যানেল নাম্বার ফাইভ সেন্টের মিষ্টি গন্ধে ভরপুর হয়ে আছে গাড়ির ভিতরটা।

‘সিগারেট খেলে অসুবিধে হবে আপনার?

‘মোটেও না। বরং সিগারেট না খেলেই ব্যাটাছেলেকে মেয়েমানুষের মত লাগে। গাড়িতে তাদের পাশে বসতে ইচ্ছে করে না।’

‘যাক বাঁচা গেল।’ বলে রানা একটা সিনিয়র সার্ভিস ধরাল। গাড়ি তখন ছুটছে পঁচাত্তর মাইল বেগে। লম্বা এক টান দিয়ে নাক-মুখ দিয়ে প্রচুর ধোয়া বের করল রানা। তারপর আগের কথার খেই ধরে বলল, ‘বিয়ের আগে প্রায় সব মেয়েই এরকম বলে। কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলেই তাদের মতামত পাল্টে যায়। স্বামীর নেশা ছাড়াবার জন্যে তখন উঠে পড়ে লেগে যায় তারা।’

মেয়েটা মাথা ঝাঁকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, বাধা দিয়ে রানা বলল, ‘দেখুন তো কাণ্ড, আপনার নামটাই জিজ্ঞেস করা হয়নি এখনও।’

‘সুলতা রায়।’

‘ক’বছর আছেন সার্ভিসে?’

‘দেড় বছর। এতদিন ফাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করেছি। এই প্রথম আমার বাইরে আসা। কপালটা ভাল, প্রথমেই আপনার সঙ্গে কাজ করবার সুযোগ পেয়ে, গেলাম।’

‘কপাল ভাল, তার মানে?’ মনে মনে হাসল রানা। ‘কপালটা তোমার খারাপ, সুন্দরী।’

‘ভাল বলব না? সুবীর সেনের সঙ্গে কাজ করবার সুযোগ ক’জনের হয়? সার্ভিসের অন্যান্য মেয়েরা তো হিংসায় মরে যাচ্ছে।’

‘আচ্ছা? এতই বিখ্যাত লোক, আমি?’ মৃদু হাসল রানা।

কথায় কথায় মেয়েটি বলল কেমন ভাবে তার সাধারণ ডিউটি থেকে তাকে সরিয়ে সাতদিন স্পেশাল ট্রেনিং দেয়া হয়েছে, তারপর কলকাতা থেকে বর্ডারে আনা হয়েছে, হেলিকপ্টারে করে। সেখান থেকে কত বন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে বর্ডার ক্রস করেছে জিপটা ভয়ে ভয়ে, এখন অন্য পথে ফিরে যাবে। আবার সেটা ভারতীয় এলাকায়।

ফেনীতে এসে সুলতা বলল ‘তেষ্টা পেয়েছে।’ দুজন দুটো ডাবের পানি খেয়ে নিয়ে আবার রওনা হলো। এরই মধ্যে আরও সহজ ও সাবলীল হয়ে এসেছে সুলতা রায়। মাসুদ রানা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে করে ওর অতীতের কথা, বাবা-মার কথা, ছেলেবেলার কথা শুনল মন দিয়ে। সুলতাও মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে যারপরনাই উৎসাহিত হয়ে ওর নিজস্ব প্রাঞ্জল ভাষায় বলে গেল অনেক কথা। পথের ক্লান্তি ভুলে গেল দুজন।

বাবা ছিলেন উকিল—ছেলেবেলায় লাক্ষৌ শহরে মানুষ, ক্যালকাটা লেডি ব্রাবোর্ন থেকে গ্রাজুয়েশন, প্রেমে ব্যর্থতা—তারপর দু’একটা পদস্থলন—শেষে সিক্রেট সার্ভিসে ঢুকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আরও স্থলন।

মেয়েটার মস্ত বড় গুণ হচ্ছে দু’চার মিনিটে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিতে পারে। নিজের কোন কথাই চেপে রাখবার চেষ্টা করল না ও। ওর জীবনের সবচাইতে গোপন কথাটাও সে বলল রানাকে। কেমন ভাবে অমানুষিক বলপ্রয়োগ করে প্রথমবার ওকে অপবিত্র করেছিল একজন নামকরা ফিল্ম ডাইরেক্টার সেকথা বলতে বলতে টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল ওর চোখ থেকে। রুমাল দিয়ে মুছে নিয়ে একটু থেমে আবার বলল, ‘কেন যে এসব কথা বলছি জানি না—ভাল করে চিনিও না আপনাকে—কিন্তু বড় ভাল লাগছে নিজের সব কথা আপনাকে বলতে। মনে হচ্ছে আমার সব কথা আপনি বুঝবেন, আপনার দ্বারা আমার কোনও ক্ষতি হতে পারে না।’

মেয়েটার কথাবার্তার ধরণ অনেকটা পুরুষের মত। চালচলনেও কিছুটা পুরুষালী ভাব। মেয়েলীপনা বা ন্যাকামির লেশমাত্র নেই ওর মধ্যে।

একটা ব্রিজের কাছে আসতেই দেখা গেল দুটো বাঁশ পুঁতে একখানা সাইনবোর্ড টাঙানো:

বিদায়। নোয়াখালী জেলার শেষ সীমা।

বেশ বড় ব্রিজ। নীচ দিয়ে নদী গেছে একটা। ফেনী নদী। গ্রীষ্মের তাপে শুকিয়ে ক্ষীণ হয়ে গেছে নদীটা। ব্রিজ পার হতে এক টাকা শুল্ক দিতে হলো। অপর পারে আরেকটা সাইনবোর্ডে লেখা:

স্বাগতম। চিটাগাং জেলার শুরু।

হাতের বাঁ ধারে অল্প কিছু দূর দিয়ে লম্বালম্বিভাবে মাটির টিলা সেই যে আরম্ভ হয়েছে, আর শেষ হতে চাইছে না কিছুতে। প্রায়ই ছোট ছোট বাজার, গঞ্জ পড়তে লাগল পথে। কাজেই গতি অনেক কমে গেল গাড়ির। সবচাইতে অসুবিধা করল বাঁশ বোঝাই গরু বা মোষের গাড়িগুলো। রাস্তার ঠিক মাঝখান দিয়ে চলে ওগুলো। দূর থেকে হর্ন বাজালে নড়ে না রাস্তার উপর থেকে। যখন কাছে যাওয়া যায় তখন হঠাৎ করে গাড়ি ঘুরিয়ে বাম ধারের অসমতল কাঁচা রাস্তার উপর নেমে পড়ে। ফলে পিছনের লম্বা বাশগুলো রাস্তার উপর আড়াআড়িভাবে চলে এসে সমস্ত পথ বন্ধ করে দেয়। কাঁচা রাস্তায় গরুর গাড়িগুলো আবার পাকা রাস্তার সঙ্গে সমান্তরাল না হওয়া পর্যন্ত অচল অবস্থায় ড্রাইভিং সিটে বসে মনে মনে এদের গুষ্টি উদ্ধার করা ছাড়া উপায় নেই।

‘কই, আপনি যে কিছুই বলছেন না! আমিই কেবল বক বক করে যাচ্ছি।’ নিজের কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে জিজ্ঞেস করল সুলতা।

‘আমি অত সুন্দর করে বলতে পারি না।’ এড়িয়ে যাবার জন্য বলল রানা।

সজোরে হেসে কথাটা উড়িয়ে দিল সুলতা। একটা মাইল-পোস্ট পার হয়ে যাচ্ছিল, চট করে দেখে নিয়ে বলল, ‘চিটাগাং টেন মাইলস।’

তখন গোধূলি লগ্ন। সারাদিন পৃথিবীর উপর অগ্নিবর্ষণ করে সূর্যটা বঙ্গোপসাগরে ডুব দিয়ে গাটা জুড়োচ্ছে এখন। পশ্চিম দিগন্তে এক-আধ ফালি সাদা মেঘ এখন অনুরাগে লাল। তারই হাল্কা আলো এসে পড়েছে সুলতার মুখের উপর। রূপকথার রাজকন্যার মত সুন্দর লাগছে ওকে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল রানা ওর মুখের দিকে। রাস্তায় পড়ে থাকা একটা ইটের উপর হোঁচট খেল গাড়িটা। ফিক করে হেসে সুলতা বলল, ‘অ্যাকসিডেন্ট করবেন নাকি?’

‘যদি করি তবে দোষ তোমার,’ উত্তর দিল রানা।

পিচ্ছিল কাতান শাড়িটা এলোমেলো হাওয়ায় কাঁধ থেকে খসে পড়েছিল কখন কোলের উপর। পাতলা সাদা ব্লাউজটা ঘামে ভিজে সেঁটে রয়েছে গায়ের সঙ্গে। ভেজা কাপড়ের মধ্য দিয়ে বক্ষ বন্ধনীর সেলাইয়ের কাজগুলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সচকিত হয়ে বুকের কাপড়টা তুলে দিয়ে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল সুলতা, ‘কী দেখছেন?’ রানার মনের পর্দায় যে রঙ ধরেছে তা দৃষ্টি এড়ায়নি ওর।

‘তোমাকে বড় সুন্দর লাগছে।’ যেন এটা একটা সাধারণ কথা, যেন এতে কারও কিছু যায় আসে না, এমনিভাবে বলতে চেষ্টা করল রানা। কিন্তু ওর কণ্ঠস্বর প্রতারণা করল ওর সঙ্গে। এমন মধুর লগ্নে এই সাধারণ কথা অদ্ভুত ব্যঞ্জনা পেয়ে শোনাল ঠিক প্রথম প্রেমের প্রথম আত্মনিবেদনের মত। এই একটি কথায় দুটি মন হঠাৎ রঙিন হয়ে উঠে সমস্ত ভুবন রাঙিয়ে নিতে চাইল আপন মনের আবীরে।

নিজের কণ্ঠস্বর শুনে নিজেই চমকে উঠল মাসুদ রানা। একী বলল ও? কেন এই বোকামি করতে গেল? তাকে কি এই জন্য পাঠানো হয়েছে পিসিআই থেকে?

রানার মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসা কথাটা থমকে দিয়েছিল সুলতাকে। কথাটা নিয়ে নিজের মনেই নাড়াচাড়া করল সে কয়েক মুহূর্ত। এত ভাল লাগল কেন কথাটা?

‘আপনি–’

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সুলতা, ওকে থামিয়ে দিয়ে রানা বলল, আর ‘আপনি’ নয়, এবার ‘তুমি’। চিটাগাং আর সাত মাইল। এখন থেকে আমি তোমার স্বামী, তুমি আমার বিবাহিতা স্ত্রী, বুঝলে?’

‘আমি তো নকল স্ত্রী, তোমার আসল স্ত্রী জানতে পারলে মারবে তোমাকে। তাই না?’

‘বিয়েই হয়নি, তার আবার আসল স্ত্রী!’

‘ওমা, এত বয়স হয়েছে বিয়ে করনি কেন? কাউকে ভালবাস বুঝি?’

‘নাহ্। ওসব বালাই নেই।’

‘সাময়িক প্রেম?’

‘প্রচুর। বাবা-মা নেই বুঝি তোমার?’

‘না।’

‘আমারও নেই। থাকলে এভাবে বখে যেতে পারতাম না।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল সুলতা। আবার খসে পড়া আঁচলটা তুলে দিল বাঁ কাঁধে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে—ফোক্সওয়াগেনের টিমটিমে হেড লাইট জ্বেলে দিল রানা।

প্রায় দু’বছর পর চিটাগাং-এ এসে বেশ আশ্চর্য লাগল রানার। শহরের ভোলটাই যেন পাল্টে গেছে। উন্নয়নের কাজটা যেন ঢাকার চাইতেও অনেক বেশি দ্রুত হয়েছে এখানে। হরেক রকম অট্টালিকা, ঝলমলে দোকান-পাট। রাস্তায় সারিসারি ফ্লোরেসেন্ট বাতি দিন করে রেখেছে রাতকে। পথঘাট বেশ পরিষ্কার মনে ছিল রানার, কাজেই স্টেশন রোডের মিসখা হোটেল চিনে বের করতে অসুবিধা হলো না কিছুই।

হোটেলের সামনে ফুটপাথের ধারে এমন বেকায়দা করে গাড়ি রাখল রানা যাতে খুব পাকা ড্রাইভারেরও কমপক্ষে দুই মিনিট সময় লাগে ওটাকে বাগে এনে রাস্তায় চালু করতে।

গাড়ি থামতেই হোটেলের পোর্টার দৌঁড়ে এল। সুলতা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল ফুটপাথে। ওর সিটটা ভাঁজ করে ইঙ্গিত করতেই পিছনের সিটে রাখা রানা এবং সুলতার সুটকেস দুটো বের করল পোর্টার। গাড়ির কাঁচ তুলে দিয়ে দরজাটা লক করে চাবিটা দিল রানা সুলতার হাতে।

নীচতলার গেট দিয়ে ঢুকেই করিডোরের বাঁ ধারে লিফট। বুড়ো লিফটম্যানের থুতনি থেকে ঝুলছে অল্প একটু পাকা ছাগলা দাড়ি। সালাম করল সে রানাকে দেখে। পোর্টারকে পাঁচতলার দশ নম্বর রুমে মাল নিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে লিফটে উঠল রানা ও সুলতা।

দোতলায় ম্যানেজারের কাউন্টার। সামনে মস্ত বড় লাউঞ্জে ফাঁক ফাঁক করে রাখা টেবিলগুলোর উপর প্লেট, কাঁটা, চামচ, ছুরি ইত্যাদি ডিনারের সরঞ্জাম পরিপাটি করে সাজানো। গ্লাসের মধ্যে সদ্য লণ্ডি থেকে ধোয়া ইস্তিরি করা ন্যাপকিন ফুলের তোড়ার মত কায়দা করে রাখা। কোনও কোনও টেবিল ঘিরে দু’জন চারজন লোক বসা। বেশির ভাগই খালি।

অল্পবয়সী ম্যানেজার ওদের দেখেই এগিয়ে এল।

‘এখানে আর আপনাদের দাঁড়াতে হবে না, স্যর। এই যে নিন আপনাদের ঘরের চাবি-পাঁচতলার দশ নম্বর রুম। আমি এন্ট্রি-বইটা পাঠিয়ে দেব ওপরে, সই করে দেবেন।’

‘ধন্যবাদ। আমাদের ঘরের ওয়েটার কে?’

‘হাসান আলী। ওকে দিয়েই বইটা পাঠাচ্ছি, স্যর।’

পাঁচতলায় উঠে এল, ওরা। দেখল সুটকেস দুটো নিয়ে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পোর্টার।

ঘরে ঢুকে প্রথমেই রানা এয়ারকুলারের হাই কুল লেখা সাদা বোতামটা টিপে দিল। মালগুলো ঘরে এনে রাখতেই পাঁচ টাকার একটা নোট বখশিশ দিয়ে দিল পোর্টারকে। আশাতিরিক্ত বখশিশ পেয়ে সালাম ঠুকে বেরিয়ে গেল সে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একজন ঝাড়ুদারের সঙ্গে একহাতে একটা বই আর অন্য হাতে কিছু পরিষ্কার বিছানার চাদর ও বালিশের ওয়াড় নিয়ে ঘরে ঢুকল হাসান আলী।

একটা আইসিআই ফ্লিট স্প্রে-গান দিয়ে সারা ঘরে, বিশেষ করে বিছানার তলে, টেবিলের নীচে আর আলমারির পিছনে, স্প্রে করল জমাদার, তারপর ভিম-এর কৌটো নিয়ে অ্যাটাচড বাথরুমে ঢুকল কমোড, বাথটাব আর বেসিনটা পরিষ্কার করবার জন্য। হাসান আলী নিপুণ হাতে পুরনো বেড শিট আর বালিশের ওয়াড় সরিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে দিল ঘরটাকে দুই মিনিটের মধ্যে। এই কাজগুলো এরা সবসময় নতুন ‘কাস্টোমারের’ সামনে করে—আগে থেকে করে রাখলে অনেক সময় আবার ডবল করে করতে হয়, তাই।

সুলতা বলল, ‘একটু জল খাওয়াতে পারো? ঠাণ্ডা?’

‘এক্ষুণি নিয়ে আসছি।’ হাসান আলী ছুটল পানি আনতে।

বড়সড় ঘরটায় পাশাপাশি দুটো সিঙ্গেল খাট—ইচ্ছে করলে জোড়া দিয়ে নেয়া যায়। কোণে একটা সাধারণ চম্বল কাঠের আলমারি। একটা মাঝারি গোছের ডাইনিং টেবিলের দু’পাশে দুটো চেয়ার রাখা। একটা ড্রেসিং টেবিল আর একটা ইজি চেয়ার। এই হচ্ছে ঘরের আসবাব।

রানাকে রিস্ট ওয়াচটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখতে দেখে সুটকেস থেকে কিছু কাপড় বের করতে করতে সুলতা বলল, ‘আমি কিন্তু আগে যাচ্ছি বাথরুমে। সারাদিনের এই ধকলের পর এক্ষুণি চান করতে না পারলে মরে যাব।’

‘মেয়েমানুষ, একবার বাথরুমে ঢুকলে তো আর বেরোতে চাইবে না সহজে।’ একটু থেমে আবার বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, তুমিই আগে যাও–আমি পরে যাব। অলওয়েজ লেডিজ ফাস্ট।’

হাসান আলী দু’হাতে দু’বোতল ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি নিয়ে ঢুকল। দুটো গ্লাস দিয়ে বোতলগুলোর মুখ ঢাকা। দশ টাকা বখশিশ পেয়ে সব ক’টা দাঁত বেরিয়ে গেল হাসান আলীর।

‘কিছু খাবে, সুলতা?’ রানা প্রশ্ন করে।

‘কেক-বিস্কিট গোছের কিছু আনতে বল। আমি এক্ষুণি গা-টা ধুয়ে আসছি।’ এক গ্লাস পানি খেয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল সুলতা।

কয়েকটা কেক পেস্ট্রি আর দু’কাপ কফি আনতে বলল রানা। হাসান আলী চলে যাচ্ছিল, আবার ডাকল রানা। আরও একটা দশ টাকার নোট ওর হাতে গুঁজে দিয়ে নিচু গলায় বলল, ‘তোমার একটা কাজ করতে হবে হাসান আলী, পারবে? টাকাটা রেখে দাও, বখশিশ।’

বিস্মিত হাসান আলী চট করে হাতটা উঠিয়ে সালাম করল দ্বিতীয় বার।

‘খুব পারব, স্যর।’ বিগলিত হাসান আলী এখন পা-ও চাটতে পারবে।

ইঙ্গিতে ওকে কাছে সরে আসতে বলে চাপা গলায় বলল রানা, ‘গত রাতে হঠাৎ ওর (চোখদুটো তেরছা করে বাথরুমের দিকে দেখাল রানা) বাবা মারা গেছেন খবর এসেছে। বাবার একমাত্র মেয়ে ও। খুব আদরের মেয়ে। খবরটা ওকে জানানো হয়নি এখনও, বুঝলে? (মাথা ঝাঁকাল হাসান আলী) এখন খবরটা ওকে হঠাৎ করে জানাতে চাই না, ওর শরীর অত্যন্ত দুর্বল, আচমকা আঘাত পেলে কী হয়ে যায় বলা যায় না। তাই না? (যেন খুব ব্যথা পেয়েছে, এমন মুখ করে সায় দিল হাসান আলী) সেজন্যে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। আমার কিম্বা ওর কোনও চিঠি বা টেলিগ্রাম এলে ম্যানেজারের কাছ থেকে তুমি নিয়ে নেবে। সেটা নিয়ে গোপনে আমার হাতে দেবে, যেন ও ঘুণাক্ষরেও টের না পায়। জিজ্ঞেস করলে বলবে কোনও চিঠি বা টেলিগ্রাম আসেনি। আর কেউ যদি ওর কাছে টেলিফোন করে বা দেখা করতে চায়, ও থাকুক বা না-ই থাকুক সোজা বলে দেবে সাহেবের সঙ্গে বাইরে গেছে। কী, পারবে না?’

‘ঠিক আছে, স্যর, কোনও চিঠিপত্র-টেলিফোন বা লোক এলে আমি সামলে নেব। কিন্তু উনি যদি কাউকে টেলিফোন করেন তখন?’

‘সে দিকটা আমি দেখব, তুমি কেবল এটুকু করলেই হবে। এখন যাও তো, চট করে কিছু খাবার নিয়ে এসো।’

একটা সিনিয়র সার্ভিস ধরিয়ে ঠাণ্ডা ঘরটায় ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল রানা। সারাদিনের একটানা পরিশ্রমের পর এতক্ষণে চোখ দুটো একটু বিশ্রাম পেল। চোখের পাপড়িতে অল্প অল্প জ্বালা অনুভব করল ও। শুধু শুধুই পুড়তে থাকল সিগারেটটা। পুড়তে পুড়তে ছোট হয়ে যখন আঙুলে আঁচ লাগল তখন চোখ মেলে দেখল উগ্র লাল রঙের একখানা খাটাউ প্রিন্ট শাড়ি সাদাসিধে একহারা করে গায়ে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরোচ্ছে সুলতা। বক্ষাবরণ পরেনি। তাই উন্নত স্তন যুগল আর শাসন মানছে না। প্রতি পদক্ষেপে দুলে উঠে দোলাচ্ছে একমাত্র দর্শকের মন।