টেবিলের উপর পরিপাটি করে সাজানো রয়েছে ব্রেকফাস্ট।

এক গ্লাস অ্যাপল জুস কয়েক ঢোকে শেষ করে ঠক করে টেবিলের উপর গ্লাসটা নামিয়ে রাখল পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের উজ্জ্বলতম তারকা শ্রীমান মাসুদ রানা—বয়স আটাশ, উচ্চতা পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি, গায়ের রঙ শ্যামলা, সে বাংলায় কথা বলে।

সকাল তখন আটটা। দশটার দিকে অফিসে একবার নিয়মিত হাজিরা দিয়ে আজ যাবে ক্লাবের সুইমিং পুলে—মিস ক্লডিন আর ডরোথিকে কথা দিয়েছে সাঁতার শেখাবে। দশটার এখন অনেক দেরী। তাই ধীরে সুস্থে দুটো কাঁচা পাউরুটি আর দুটো মচমচে টোস্টের উপর এক আঙুল পুরু করে চিটাগাং-এর ভিটা মাখন লাগিয়ে নিল রানা। পরিজ আর সেই সঙ্গে দুধের বাটিটা ঠেলে সরিয়ে দিল ডান ধারে, খেল না। তারপর একটা কাঁচা রুটির উপর কোয়েটা থেকে আনানো হান্টারস বিফ কেটে স্লাইস করে সাজিয়ে এক কামড় দিল। সেই সঙ্গে এক প্লেট স্ক্র্যাম্বলড্ এগের থেকে এক এক টেবল-স্পূনফুল অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকল। বিফ শেষ হতেই আরেকটা স্লাইসের উপরে সাজানো হলো ক্রাফ্‌ট্ পনির। মিনিট খানেকের মধ্যে সেটাও যখন শেষ হয়ে এল তখন মচমচে টোস্টের উপর হাল্কা করে মিচেল্‌সের গুয়াভা জেলি লাগানো হলো–সেই সঙ্গে চলল গোটা দুই ইয়া বড় মুন্সিগঞ্জের অমৃতসাগর কলা। তারপর ফ্রিজ থেকে সদ্য বের করা বোতল থেকে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে নিল রানা একটা গ্লাসে। তিন ঢোকে গ্লাসটা শেষ করতেই ঘরে ঢুকল রাঙার মা।

বুড়িকে এক নজর দেখে নিয়ে নিশ্চিত মনে আরাম করে সোফায় হেলান দিয়ে জুতোসুদ্ধ পা তুলে দিল রানা টেবিলের উপর। তারপর একটা সিনিয়র সার্ভিস ধরিয়ে চোখ বন্ধ করে মারল কষে লম্বা টান। চোখ বন্ধ করেই ও অনুভব করল ফরসা টেবিলক্লথের উপর রাখা জুতো জোড়ার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে বুড়ি পট থেকে কফি ঢেলে রানার হাতের কাছে টি-পয়ের উপর রাখল, তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

পরপর দু’কাপ কড়া কফি খেয়েও গতরাত্রি জাগরণের গ্লানিটা শরীর থেকে গেল না মাসুদ রানার। ক’দিন ধরে কিছু কাজ নেই হাতে। আজ টেনিস, কাল গলফ, পরশু সুইমিং, তার পরদিন রোয়িং, ফ্লাইং, ডান্সিং, ব্রিজ ইত্যাদি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে রানা। খাঁচায় বন্দি বাঘের মত ছটফট করছে তার বিপদ আর রোমাঞ্চপ্রিয় মনটা। গত রাতে তিনটে পর্যন্ত পোকার খেলেছে ক্লাবে—সেই সঙ্গে চলেছে প্রচুর পরিমাণে স্কচ উইস্কি, এবং তারপর…

একা মানুষ। ৫/১-বি পুরানো পল্টনে ছোট্ট একটা একতলা বাড়ি ভাড়া করে আছে সে। তিনখানা বড় বড় ঘর। লাইট, কল, অ্যাটাচড বাথ, কিচেন, সার্ভেন্টস কোয়ার্টার, সব ব্যবস্থা ভাল। গাড়ি-বারান্দার সামনে ছোটখাট বেশ সুন্দর একটা লন’ আছে। ভাড়া পাঁচ শ’ টাকা। অফিস থেকেই ভাড়া পায় মাসে মাসে বাড়িওয়ালা। ধনীর দুলাল সেজে থাকতে হয় রানাকে অফিসের হুকুমেই।

ঘর তিনখানার একখানা রানার বেডরুম, একটা ড্রইংরুম; বাকিটা খালি পড়ে থাকে হঠাৎ যদি কোনও অতিথি এসে পড়ে, সেই অপেক্ষায়।

মোখলেস বাবুর্চির হাতে ইংলিশ খানা খাচ্ছিল এতদিন, হঠাৎ বছর দুয়েক আগে একদিন রাঙার মা এসে উপস্থিত হলো। জিজ্ঞেস করল, ‘ও আব্বা, রান্নার নোক নাগবি?’

প্রথম দর্শনেই রানার পছন্দ হয়ে গেল বুড়িকে। বয়স পঞ্চান্নর উপর, দাঁত একটাও নেই। এ বয়সেও শরীর একেবারে ঢিলে হয়ে যায়নি—আঁটসাট কর্মঠ চেহারা। আর আসল কথা হলো, কেন জানি রানার নিজের মরা মায়ের কথা মনে পড়ল ওকে দেখে। কোথায় যেন মিল আছে। বলল, ‘ভাল পাক করতে জান?’

‘জানি।’ কথাটার মধ্যে আত্মপ্রত্যয় আছে।

‘আগে কোথায় কাজ করেছ?’

‘ওমা! নোকের বাসায় কাজ করতি যাব কেন? আমার নিজিরই…’ হঠাৎ চেপে গেল বুড়ি। তারপর একটু মলিন হাসি হেসে বলল, ‘বিটার বউয়ের সাথি নাগ করে আসছি।’

‘বাড়ি কোথায় তোমার?’

‘যশোহর।’

‘ছেলে-বউ কোথায়?’

‘সিখানেই।’

‘ও, পালিয়ে এসেছ ঢাকায়? দুদিন পর আবার মন টানলেই এখান থেকে পালাবে। যাও তুমি, এমন লোক আমার লাগবে না।’

এই উত্তরই যেন আশা করেছিল ঠিক এমন ভাবে কোনও রকম যুক্তিতর্কের অবতারণা না করেই চলে যাচ্ছিল বুড়ি। হঠাৎ রানা কী ভেবে ডাকল পিছন থেকে। বুড়ি ঘুরতেই রানা দেখল জল গড়াচ্ছে ওর চোখ দিয়ে। বুঝল রানা, এক কাপড়ে রাগের মাথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে–ঢাকায় কোথাও কিছু চেনে না—এ বাড়ি ও বাড়ি ঠোকর খেয়ে ফিরছে, কিন্তু চাকরি হয়নি। খাওয়া-দাওয়া হয়নি কদিন কে জানে। এমন অপ্রত্যাশিত দুর্বিপাকে পড়ে রাগে দুঃখে হতাশায় ভেঙে পড়েছে বুড়ি। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে কাছে এসে দাঁড়াতেই রানা বলল, ‘তা বেতন চাও কত?’

‘আমি তো জানিনে, কাজের নোককে সবাই যা দেয় তাই দেবেন।’

‘বেশ। থাকো আমার এখানেই। মোখলেস তো ওর হাঁড়ি পাতিল ধরতে দেবে না। তুমি এখন খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করো, বিকেলে ওর সঙ্গে গিয়ে দোকান থেকে সব কিনে আনবে।’

সেই বুড়ি রয়েই গেল। ঝোঁকের মাথায় ওকে থাকতে বলেই খুব আফসোস হয়েছিল রানার—কেন শুধু শুধু জঞ্জাল বাড়াতে গেলাম! বেশ তো চলছিল, কোনও হাঙ্গামা ছিল না। ভেবেছিল–কোনও ছুতো পেলেই বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু পরদিন ওর হাতের বাঙালী রান্না খেয়ে পরিতৃপ্তির একটা ঢেকুর তুলে সিদ্ধান্ত নিল রানা—ছলে বলে কৌশলে যেমন করে হোক একে রাখতেই হবে, ছাড়া যাবে না।

এখন অবশ্য বাজার করা ছাড়া মোখলেসের অন্য কাজ নেই—অল্পদিনেই বুড়ি বিলিতি রান্নাতেও ওকে ছাড়িয়ে গেছে, আর মোখলেসও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।

টেলিফোনটা বেজে উঠল।

‘হ্যালো, ফাইভ-এইট-টু-সেভেন,’ রানা ধরল।

‘কে, মাসুদ সাহেব বলছেন?’ প্রশ্ন এল অপর দিক থেকে।

‘হ্যাঁ। কী খবর, সারওয়ার?’

‘এক্ষুণি আপনাকে একটু অফিসে আসতে হবে, স্যর। বড় সাহেব খুব জরুরী তলব করেছেন আপনাকে।’ মেজর জেনারেল রাহাত খানের পিএ গোলাম সারওয়ার বলল নির্বিকার কণ্ঠে।

বিশেষ করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয় উপস্থিত হলে চেহারা-চালচলনে চেষ্টাকৃত ভাবে একটা নির্লিপ্ত ভাব এনে এক ধরনের আনন্দ পায় গোলাম সারওয়ার। বোধহয় আত্মসংযমের আনন্দ। রানার খুব ভাল করে জানা আছে এ কণ্ঠস্বর। তাই জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাপার কী বল তো, সারওয়ার! নতুন গোলমাল বাধল কিছু?’

‘কোথায় আছেন, স্যর! হুলুস্থুল কারবার। ভোর পাঁচটা থেকে অফিস করছি আজ। জলদি চলে আসেন।’ বলেই ফোন ছেড়ে দিল কাজের চাপে সর্বক্ষণ ব্যস্ত অক্লান্ত পরিশ্রমী গোলাম সারওয়ার অন্য কোনও প্রশ্নের সুযোগ না দিয়েই।

মাসুদ রানা চোখ বন্ধ করে স্পষ্ট দেখতে পেল টেলিফোনটা রেখেই চটপট গোটা কতক ইমিডিয়েট লেবেল লাগানো ফাইল নিয়ে গোলাম সারওয়ার ছুটল চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের কামরার দিকে।

ঘন কালো ভুরু জোড়া অল্প একটু উঁচু করে ছোট্ট একটা শিস দিল মাসুদ রানা। তারপর দ্বিতীয় সিগারেটের অর্ধেক থাকতেই অ্যাশট্রেতে ঠেসে মুচড়ে আগুনটা নিভিয়ে উঠে দাঁড়াল।

প্যান্ট আর জুতো পরাই ছিল—ভোরবেলা গোসল সেরেই এগুলো পরে ফেলে ও সব সময়। ড্রয়ার থেকে পিস্তল ভরা হোলস্টারটা বের করে বাঁ কাঁধে ঝুলিয়ে নিল রানা। পিস্তলটা খুব দ্রুত কয়েকবার হোলস্টার থেকে বের করে ঠিক জায়গা মত হাতটা পড়ছে কি না দেখে নিল। তারপর রোজকার অভ্যাস মত স্লাইডটা আটবার টেনে একে একে আটটা গুলি বের করে পরীক্ষা করল ইজেক্টার ক্লিপটা ঠিকমত কাজ করছে কি না। ম্যাগাজিন রিলিজটা টিপতেই সড়াৎ করে বেরিয়ে এল খালি ম্যাগাজিন। স্লাইড টেনে ধরে চেম্বারে একটা বুলেট ঢুকিয়ে আস্তে হ্যামারটা নামিয়ে দিল রানা। ঠিক ফায়ারিং পজিশনে এনে রাখে ও সব সময় তার বিপদসঙ্কুল রোমাঞ্চকর জীবনের একমাত্র বিশ্বস্ত সাথী এই পয়েন্ট থ্রি-টু ক্যালিবারের ডাবল অ্যাকশন অটোমেটিক ওয়ালথার পিপিকে পিস্তলটি। ম্যাগাজিনে সাতটা বুলেট ভরে যথাস্থানে ঢুকিয়ে দিল রানা। ক্যাচের সঙ্গে আটকে একটা ক্লিক শব্দ হতেই সন্তুষ্ট চিত্তে আবার শোল্ডার হোলস্টারে ভরে রাখল ও তার ছোট্ট যন্ত্রটা। তারপর একটা নীল টি-শার্ট পরে টেবিলের লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ফিরে ভাল করে দেখে নিল শোল্ডার হোলস্টারটা কোনও দিক থেকে দেখা যাচ্ছে কি না। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে ওর একান্ত প্রিয় জাগুয়ার এক্স কেই গাড়িতে স্টার্ট দিল।

‘ও আব্বা, দরোজার চাবিটা নেছেন?’ রাঙার মা এসে দাঁড়াল।

‘না, তো কেন? তুমি বাসায় থাকবে না?’

‘দোফরে একটু মিরপুরের মাজার যাব।’

‘ড্রয়ার থেকে আমার চাবিটা নিয়ে মোখলেসের কাছে দিয়ে যেও।’

‘ও-ও ত আমার সঙ্গে যাবি।’

‘বেশ, তোমার চাবিটা জলদি আমাকে দাও—তুমি ড্রয়ার থেকে আমারটা নিয়ে নিও। নাও, তাড়াতাড়ি করো।’

বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু হাসল রানা। যেদিনই অফিস থেকে ওর বিশেষ টেলিফোন আসবে, সেদিনই বুড়ির মিরপুরের মাজারে যাওয়া চাই। এই দুই বছরের মধ্যে রাঙার মা দেখেছে, যতবারই এমন টেলিফোন এসেছে ততবারই আব্বা কয়দিন আর বাড়িতে ফেরেনি। প্রায়ই শরীরে কাটাকুটি নিয়ে বাড়ি ফেরে আব্বা। একবার তো বিশদিন পর খাঁটিয়ায় করে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে দিয়ে গেল কয়েকজন লোক—সারা অঙ্গে জখমের দাগ। একমাস কত সেবা শুশ্রূষা করে। জ্যান্ত করতে হয়েছে তাকে। আব্বা যে কী কাজ করে তা ঠিক জানে না সে, তবে কাজটা যে খুবই ভয়ঙ্কর এবং বিপজ্জনক তা সে বুঝতে পারে। সদাসর্বদা তাই শঙ্কিত হয়ে থাকে সে। একেক বার মনে হয় আব্বা বোধহয় পুলিশের নোক; আবার সন্দেহ হয়, পুলিশের নোক যদি হয় তবে মেজাজ এত ঠাণ্ডা কেন? গোলাগুলির সঙ্গে কারবার আব্বার—তাই তো আব্বার সঙ্গে সব সময় ছোট-বন্দুক থাকে। এইটাই আব্বার চাকরি, বিপদ আছে বলেই না মাসে মাসে ষোল শ’ টাকা করে মাইনে দেয় আব্বাকে। কোনও ভাবে বারণ করতে পারে না সে, তাই যতবারই রানা কোনও কাজে হাত দেয়, ততবারই রাঙার মা মিরপুরের মাজারে গিয়ে মানত করে আসে। যখন সুস্থ বা অসুস্থ অবস্থায় সে ফিরে আসে, তখন মোখলেসকে দিয়ে মানত পুরো করে দেয়। বিরক্ত হয়ে মোখলেস একদিন রাঙার মার এসব গোপন কথা বলে দিয়েছে রানাকে।

মতিঝিল কমার্শিয়াল এরিয়ার একটা সাততলা বাড়ির পিছন দিকটায় গাড়ি পার্ক করে লিফটের বোতাম টিপল মাসুদ রানা। ওকে দেখে লিফটম্যান কোনও প্রশ্ন না করেই ফিফথ ফ্লোর, অর্থাৎ ছতলায় উঠে এল। ছয় এবং সাততলার সবটা জুড়ে পিসিআই বা পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের অফিস। নিচেরতলাগুলো হরেক রকম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টুকরো টুকরো করে ভাড়া নিয়ে দফতর খুলেছে।

ছ’তলার বেশির ভাগটাই জুড়ে রয়েছে রেকর্ড সেকশনের ব্যস্ত-সমস্ত কেরানির দল, জনা পনেরো মেয়ে-পুরুষ টাইপিস্ট, স্টেনো ইত্যাদিতে। কেবল ডানধারের সব শেষে করিডোরের দুপাশে মুখোমুখি চারটে কামরায় বসে রানা আর তার তিন সহকর্মী।

সাততলায় মেজর জেনারেল রাহাত খান আর চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর কর্নেল শেখের কামরা। আর বাকিটায় অত্যাধুনিক সরঞ্জামে সুসজ্জিত ওয়্যারলেস সেকশন। সাড়ে তিন শ’ কিলোওয়াটের অত্যন্ত শক্তিশালী ট্রান্সমিটার রয়েছে ছাতে। বিদঘুঁটে সব যন্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে কাজ করছে স্পেশাল ট্রেনিং প্রাপ্ত জনাকয়েক অপারেটর, কানে হেডফোন। মাইেক্রোওয়েভ, সানস্পট আর হেভি সাইড লেয়ারের জগতে আছে এরা। পাশের টেবিলে রাখা শর্টহ্যাণ্ড খাতা, ডিকটাফোন।

সব মিলিয়ে নিখুঁত এ প্রতিষ্ঠানটি। কোনও গোলমাল নেই; যেন আপনাআপনি সব কাজ হয়ে যাচ্ছে, এমন শৃঙ্খলা।

মাসুদ রানা প্রথমেই ঢুকল নিজের কামরায়। ঘরটার চারভাগের একভাগ কার্ড বোর্ডের পার্টিশন দিয়ে আলাদা করা। সেখানে টাইপিস্ট মকবুল বসে রানার গত কেসটার পূর্ণ বিবরণ টাইপ করছে। রানাকে দেখে পিঠটা কুঁজো করে উঠে দাঁড়াল মকবুল। ‘বোসো,’ বলে সুইংডোরটা ঠেলে নিজের ঘরে ঢুকল রানা।

ইন লেখা বেতের কারুকাজ করা ট্রে-তে গোটা কয়েক ফাইল জমা হয়ে আছে। ওগুলোর দিকে অনুকম্পার দৃষ্টিতে চেয়ে একটু হাসল রানা। ভাবল আজ বাছাধনেরা একটু বিশ্রাম নাও, আজ আর তোমাদের কাছে ভিড়ছি না।

টেবিলের উপর হাতের ডানধারে রাখা ইণ্টারকমের একটা বোতাম টিপে রানা বলল, ‘মাসুদ রানা বলছি, আমাকে ডেকেছিলেন, স্যর?’

গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর এল, ‘ওপরে এসো।’

বুকের মধ্যে ছলাৎ করে উঠল খানিকটা রক্ত। কেমন একটা আনন্দ শিহরনের মত অনুভব করল রানা এক সেকেণ্ডের জন্য। মাসখানেক পর আজ আবার গিয়ে দাঁড়াবে সেই তীক্ষ্ণ দুটি চোখের সামনে—যে চোখের অধিকারীকে আজ সাত বছর ধরে ও ভক্তি করেছে আর ভালবেসেছে। ওই ক্ষুরধার দৃষ্টির ইঙ্গিতে কতবার কত ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ও বিনা দ্বিধায়।

লিফটের দিকে না গিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোল রানা। সুন্দরী রিসেপশনিস্ট রানাকে দেখে মিষ্টি করে হাসল। রানাও একটু হেসে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।

ডানধারে সবশেষের ঘরটায় বসেন রিটায়ার্ড মেজর জেনারেল রাহাত খান। বাঙালীদের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্রিটিশ আর্মি ইন্টেলিজেন্সের এত উপরে উঠতে পেরেছিলেন। ১৯৫২ সালে শিশু রাষ্ট্র পাকিস্তান যখন বহির্বিশ্বের ক্রমবর্ধমান কুচক্রের বিরুদ্ধে অত্যন্ত শক্তিশালী কোনও প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি করছে, ঠিক সেই সময় অবসর গ্রহণ করলেন আর্মি ইন্টেলিজেন্সের প্রতিভাবান মেজর জেনারেল রাহাত খান। সঙ্গে সঙ্গেই নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হলো, নাম দেওয়া হলো পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স—এবং দ্বিধামাত্র না করে কর্ণধার হিসাবে রাহাত খানকে বসিয়ে দেয়া হলো এর মাথায়। অনেক বাক-বিতণ্ডার পর ঢাকায় এর হেড-কোয়ার্টার স্থাপনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে গৃহীত হলো।

নিজহাতে এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন রাহাত খান মনের মত করে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে কয়েক বছরের মধ্যে এত বেশি সুনাম অর্জন করেছে এ প্রতিষ্ঠান যে আমেরিকা, বৃটেন আর সোভিয়েট ইউনিয়নের গুপ্তচর বিভাগ এখন পিসিআইকে নিজেদের সমকক্ষ বলে স্বীকার করতে গর্ব অনুভব করে।

কিছুটা গোপনীয়তার খাতিরে আর কিছুটা পাকিস্তানের বাইরে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র কার্যরত পিসিআই এজেন্টদের গতিবিধির এবং জরুরী খবর আদান-প্রদানের সুবিধার জন্য বাড়িটা ভাড়া নেয়া হয়েছে একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ছদ্মনামে। মস্ত বড় এক সাইন বোর্ড টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে, তাতে ইংরেজিতে লেখা:

ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং করপোরেশন,

এক্সপোর্টার্স-ইমপোর্টার্স-ইনডেনটার্স।

ব্যবসার খাতিরে বা চাকরির খোঁজে কেউ যদি ভুল করে এখানে এসে ওঠে, তবে রিসিপশনিস্টের মিষ্টি হাসি এবং কয়েকটা প্রশ্নের না-বাচক উত্তর নিয়েই তাকে সন্তুষ্ট চিত্তে ফিরতে হয়।

‘আসুন, স্যর। বড় সাহেব আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’ বলল গোলাম সারওয়ার। টেলিফোন করবার ঠিক চার মিনিটের মধ্যে রানাকে সশরীরে উপস্থিত দেখে একটু বিস্মিতই হলো সে। তারপর আবার আপন কাজে মগ্ন হয়ে গেল।

আস্তে টোকা দিয়ে দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করল রানা। পুরু কার্পেটে আগাগোড়া মোড়া মস্ত ঘরটা। উত্তর দিকের জানালার দামি কার্টেনটা একপাশে সরানো। পুরু বেলজিয়াম কাঁচে ঢাকা মস্ত সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপর পা তুলে দিয়ে রিভলভিং চেয়ারে আরাম করে বসে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে কী যেন ভাবছেন রাহাত খান। আঙুলের ফাঁকে কিং সাইজের একটা জ্বলন্ত চেস্টারফিল্ড সিগারেট। আমেরিকান টোস্টেড টোবাকোর গন্ধ সারা ঘরে।

দরজাটা খুট করে বন্ধ হতেই চোখ ফিরিয়ে একবার আপাদমস্তক দেখলেন রানাকে, তারপর টেবিল থেকে পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসলেন রাহাত খান। মাথাটা একটু ডান দিকে ঝাঁকিয়ে আবছা ইঙ্গিতে বসতে বললেন রানাকে।

এসব ইঙ্গিত রানার মুখস্থ—বিনা বাক্যব্যয়ে সামনের একটা চেয়ারে বসে পড়ল রানা। এবার তার আটান্নতম জন্মবার্ষিকীতে রানার উপহার দেয়া রনসন গ্যাস লাইটারের তলায় চাপা দেয়া একটা চার ভাঁজ করা কাগজ তুলে নিয়ে রাহাত খান বললেন, ‘এটায় একবার চোখ বুলিয়ে পকেটে রেখে দাও। মজার জিনিস।’

ভাঁজ খুলে দেখল রানা, ক্রীম কালারের অনিয়নষ্কিন পেপারে ইংরেজিতে টাইপ করা একটা চিঠি ওটা। এ-ফোর সাইজ অর্থাৎ ২১০×২৯৭ মিমি কাগজ। বেশ কিছুদূর গড়গড় করে পড়ে গেল ও, কিন্তু অর্থ কিছুই বুঝতে পারল না। সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা চিঠিটা। হঠাৎ চিঠিটার উপর দিকে ডান ধারে একটা বিশেষ চিহ্ন দেখেই রানা বুঝল এটা ইণ্ডিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের চিঠি। এই চিহ্ন আগেও দেখেছে ও কয়েকবার।

মুখ তুলে রাহাত খানের দিকে চাইতে তিনি ইঙ্গিত করলেন ওটা পকেটে রেখে দেবার জন্যে। বেশি কথা বলা পছন্দ করেন না তিনি, তাই যতটা সম্ভব আকারে-ইঙ্গিতেই কাজ সারেন।

এবার আর একটা কাগজ টেবিলের উপর রানার দিকে একটু ঠেলে দিলেন তিনি। বললেন, ‘ওই চিঠির অনুবাদ। মন দিয়ে পড়ো। কোথাও বুঝতে না পারলে জিজ্ঞেস করবে।’

রানা একবার খান সাহেবের মুখের দিকে চাইল। কিছুই আন্দাজ করা গেল না, সে মুখ দেখে। গোঁফ দাড়ি পরিষ্কার করে কামানো। কপালে আর গালে বয়সের ভাজ পড়েছে কয়েকটা। কাঁচা পাকা ভুরু। এ ছাড়া ঋজু দেহটায় প্রৌঢ়ত্বের আর কোনও চিহ্ন নেই। ইজিপশিয়ান কটনের ধবধবে সাদা স্টিফ কলার শার্ট, সার্জের সুট আর ব্রিটিশ কায়দায় বাধা দামি টাইয়ের নট—সবটা মিলিয়ে খুব সপ্রতিভ চেহারা বুড়োর। তীব্র চোখ দুটো এখন নিরাসক্তভাবে চেয়ে আছে সামনের দেয়ালে টাঙানো অ্যাংলো-সুইস ইলেকট্রনিক ঘড়িটার দিকে।

একটু ঝুঁকে চিঠিটা তুলে নিল রানা টেবিলের উপর থেকে। ইংরেজিতে লেখা।

সে চিঠির বাংলা করলে দাঁড়ায়:

মঙ্গলবার

‘এল্’ সেন্টারে তোমার কাজ প্রশংসা অর্জন করেছে। নতুন কাজের ভার দেয়া হচ্ছে। তোমার ফোক্সওয়াগেন নিয়ে আগামীকাল, বুধবার ঠিক এগারোটায় ডি-সি ফেরী পার হও। ১৬৫ মাইল পথ, গড়পরতা ৪০ মাইল বেগে চলবে। বেলা তিনটা পঁয়তাল্লিশে চারজন ইপিআর সৈন্য তোমার গাড়ি থামিয়ে চারটে প্যাকেট তুলে দেবে গাড়ির সামনের বুটে। সেই সঙ্গে গাড়িতে উঠবে একজন মহিলা। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে দশ নম্বর রুম বুক করা আছে তোমাদের জন্য নির্দিষ্ট হোটেলে। সেখানে লাগেজ উঠিয়ে প্যাকেটসুদ্ধ গাড়িটা মেয়েটির হাতে ছেড়ে দিয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য অপেক্ষা করবে হোটেলেই।

দুবার আগাগোড়া চিঠিটা পড়ে মুখ তুলল মাসুদ রানা। দেখল দুটো চোখ গভীর মনোযোগের সঙ্গে তাকে পরীক্ষা করছে।

‘কী বুঝলে?’ প্রশ্ন করলেন রাহাত খান।

‘সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার, স্যর! ভারতীয় কোনও গুপ্তচরকে গাড়ি চালিয়ে ঢাকা থেকে চিটাগাং যাবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আজই এগারোটার সময়।’ চট করে রিস্টওয়াচটা দেখে নিয়ে আবার রানা বলল, ‘সুপরিকল্পিত কোনও প্ল্যান বলেই মনে হচ্ছে। পৌনে চারটেয় কুমিল্লা ছাড়িয়ে চোদ্দগ্রামের কাছাকাছি বর্ডারের পাশ দিয়ে গাড়ি যাবে, তখন ইপিআর-এর ছদ্মবেশে কয়েকজন ভারতীয় সেনা গাড়িতে কিছু মাল তুলে দেবে। চিটাগাং-এ কোনও সাঙ্ঘাতিক ঘটনা ঘটতে চলেছে, স্যর। নিরাপত্তার জন্যে কাজটা দুভাগে ভাগ করে দেয়া হয়েছে—ছেলেটার কিছুটা, মেয়েটার কিছুটা।’

রানার মধ্যে এই হঠাৎ উত্তেজনার সঞ্চার দেখে একটু হাসলেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। বললেন, ‘ঠিক ধরেছ। এখন শোনো। এই সাঙ্কেতিক চিঠিটা নিতান্ত ভাগ্যক্রমে পাওয়া গেছে ভারতের এক নামকরা গুপ্তচর সুবীর সেনের পকেটে। গতরাতে আড়াইটার দিকে শাহবাগ হোটেল থেকে ঠোঁটে গালে লিপস্টিকের দাগ নিয়ে মাতাল অবস্থায় ফিরছিল সে গাড়ি চালিয়ে। ঢাকা ক্লাবের সামনে একটা শালগাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে চুরমার হয়ে গেছে সে গাড়ি।’

রানার মনে পড়ে গেল, গত রাতে ক্লাব থেকে ক্লডিনকে নিয়ে ফেরার পথে একটা সাদা ফোক্সওয়াগেনকে প্রায় চুরমার অবস্থায় দেখেছে ও ঢাকা ক্লাবের সামনে। বলে ফেলল, ‘গাড়িটা আমি দেখেছি, স্যর।’

ভুরু কুঁচকে তিরস্কারের ভঙ্গিতে তার দিকে চেয়ে রাহাত খান বললেন, ‘ভোর সোয়া-পাঁচটায় মিলিটারি ক্রেন এসে উঠিয়ে নিয়ে গেছে সে গাড়ি। রাত আড়াইটা থেকে ভোর সোয়া পাঁচটা—এর মধ্যে তুমি দেখলে কী করে সে গাড়ি? লম্পট সুবীর সেনের মত তুমিও নিশ্চয়ই ফিরছিলে কোনখান থেকে, রানা?’

চুপ করে থাকল রানা। গতরাতের অনাচারের কথা কঠোর নীতিপরায়ণ সত্যনিষ্ঠ রাহাত খানের কাছে আর গোপন থাকল না!

‘নিজেকে শুধু শুধু অপচয় কোরো না, রানা।’ রানার অপরাধী মুখের দিকে চেয়ে বললেন খান। দুই সেকেণ্ড চুপ করে থেকে আবার বললেন, ‘যাক, যা বলছিলাম, চিঠিটা সে পেয়েছে খুব সম্ভব পাক এয়ারলাইনসের কোনও এয়ার হোস্টেসের কাছ থেকে। কাল সন্ধ্যার ফ্লাইটে এই দু’মুখো সাপ (যে সমস্ত পাকিস্তানী মুসলমান ভারতের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করে তাদেরকে খান সাহেব ঘৃণা ভরে দু’মুখো সাপ বলেন) কলকাতা থেকে এ চিঠি নিয়ে এসেছে এবং রাতে সেনকে এ চিঠি আর প্রচুর চুম্বন উপহার দিয়েছে।’

আরেকটা সিগারেট ধরাবার জন্যে থামলেন রাহাত খান। সেই ফাঁকে রানা। জিজ্ঞেস করল, ‘চিঠিটা আমাদের হাতে এল কী করে, স্যর?’

চোখে ধোয়া যাওয়ায় চোখ দুটো পেঁচিয়ে উপর দিকে ঘুরিয়ে রাহাত খান ঠোঁট থেকে আঙুলের ফাঁকে সিগারেট নিয়ে বললেন, ‘হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ডাক্তার ওর পকেট থেকে এ চিঠি পেয়ে পুলিশকে দিয়েছে। পুলিশ সে কোড ব্রেক করতে না পেরে ভোর সাড়ে চারটায় আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। আমাদের কোড এক্সপার্ট আধ ঘণ্টায় সে কোড ব্রেক করে আমার কাছে জরুরী টেলিফোন করেছে। এগুলো রুটিন ওয়ার্ক। এখন তোমার কাজটা বুঝিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। শোনো, সুবীর সেন এখন আমাদের হাতের মুঠোয়; এয়ার হোস্টেসকে চিনে বের করা আমাদের বিশ মিনিটের কাজ; ইপিআর-এর ছদ্মবেশে ভারতীয় সৈন্যদের এবং সেই মহিলা গুপ্তচরকে আমরা অনায়াসে বামাল গ্রেপ্তার করতে পারি। এসব কাজ মোটেই কঠিন নয়। কিন্তু এসব করলে আসল সূত্রটা যাবে হারিয়ে। আমি জানতে চাই ভারতের এই গোপন তৎপরতার আসল উদ্দেশ্য কী—গোড়াটা কোথায়। প্যাকেটে করে কী জিনিস চালান হচ্ছে, যাচ্ছে কার কাছে, এবং কেন। বুঝতে পেরেছ?’

মাথা ঝাঁকাল রানা। এত কথার মধ্যে এবার বেশ পরিষ্কার হয়ে এল আসলে তার কাজটা কী।

‘আজই বুধবার। এখন ঘড়িতে নটা বাজতে পাঁচ।’ এবার একটু চাঞ্চল্যের রেশ পাওয়া গেল রাহাত খানের কণ্ঠে। ঠিক এগারোটায় নারায়ণগঞ্জ ফেরিঘাটে পৌঁছতে হবে তোমাকে সুবীর সেনের পরিচয়ে। একটা সাদা ফোক্সওয়াগেনের সামনে-পিছনে সেনের গাড়ির নাম্বার প্লেট লাগানো হয়ে গেছে এতক্ষণে। দু’ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে সেটা নিয়ে তুমি রওনা হবে চিটাগাং-এর পথে।

কথাটা বলে আধ মিনিট খানেক সমস্ত ব্যাপারটা মনে মনে পর্যালোচনা করে দেখলেন রাহাত খান অন্যমনস্কভাবে। তারপর আবার বললেন, ‘আসল সুবীর সেন যে আমাদের হাতে বন্দি হয়েছে, সে খবর সম্পূর্ণ চেপে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেনকে সোয়া পাঁচটার দিকে মেডিকেল কলেজ থেকে সরিয়ে আর্মি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওর গাড়িটা মিলিটারি ক্রেন দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আগেই বলেছি। হোটেল ক্যাসেরিনায় টেলিফোন করে বলে দেয়া হয়েছে, ‘সেন সাহেব আমাদের বাসায় রাত কাটিয়েছেন; বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় কাল রাতে আর হোটেলে ফিরতে পারেননি। আজ জরুরী কাজে চিটাগাং চলে যাচ্ছেন—দু’একদিন পর ফিরবেন, তা-ও আরও নিশ্চিত হবার জন্যে অ্যাংলো ম্যানেজার এডি কোস্টারকে ডেকে পাঠিয়েছি এখানে—একটু টিপে দিলেই সব পরিষ্কার বুঝবে ছোকরা। কাজেই সেনের দুর্ঘটনার খবরটা চাপা পড়ে যাচ্ছে। বর্ডারের সৈন্যরা বা মেয়েটি টের পাচ্ছে না কিছুই, সাবধানও হতে পারছে না।’

‘কিন্তু, স্যর, যে কোনও একজন ওয়াচার কি যথেষ্ট ছিল না? আমাকে পাঠাচ্ছেন কেন?’ রানা আরেকটু পরিষ্কার করে জানতে চায় সব কথা।

‘তার কারণ, চিঠিটা পড়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বিরাট কোনও পরিকল্পনার প্রায় সমাপ্তির দিকে চলে এসেছে ওরা। সুচিন্তিত সুষ্ঠু আয়োজন দেখছি সবদিকে। তাই পাঠাচ্ছি তোমাকে। আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপার জানতে হবে তোমার—কী আছে প্যাকেটে; কাকে দেয়া হচ্ছে সেটা; আর কেন দেয়া হচ্ছে। বুঝেছ?’

‘জী, স্যর।’ মাথা ঝাঁকাল রানা।

‘ওদের সমস্ত কুমতলব বানচাল করে দিতে হবে আমাদের। তাই আমাদের সবচেয়ে…’ বলেই ব্রেক চাপলেন জেনারেল, ‘মানে, মোটামুটি একজন বুদ্ধিমান লোককে পাঠাতে হচ্ছে। এখন তোমার কিছু প্রশ্ন থাকলে বলো।’

রানা বলল, ‘গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি আমি, কিন্তু ঠিক কোন হোটেলে উঠতে হবে জানা নেই।’

‘দাঁড়াও, তার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।’ ইন্টারকমের একটা বোতাম টিপে রাহাত খান বললেন, ‘শেখ, কোনও খবর পেলে?’

‘জী, স্যর। আমি আসছি এখুনি।’ ইন্টারকমের ভিতর দিয়ে চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটার কর্নেল শেখের গলাটা কেমন ধাতব খনখনে শোনাল।

লম্বা চেস্টারফিল্ডের প্যাকেট থেকে একটা চিপ্টে যাওয়া সিগারেট বের করলেন রাহাত খান প্যাকেটের উপর টোকা দিয়ে দিয়ে। তারপর রনসন গ্যাস লাইটার দিয়ে ধরিয়ে নিলেন একটা দিক। রানারও হঠাৎ সিগারেটের তেষ্টা পেল খুব। এই ঘর থেকে বেরিয়েই একটা সিনিয়র সার্ভিস ধরিয়ে ফুসফুস ভর্তি করে ধোয়া নেবে ভাবতেই জিভে জল এসে গেল ওর। মনে হলো কত যুগ যেন সিগারেট খায়নি। কয়েক সেকেণ্ড ইন’ ট্রের কয়েকটা জরুরী কাগজে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলেন রাহাত খান। তারপর রানার দিকে চেয়ে বললেন, ‘চিটাগাং-এর সব হোটেলেই টেলিফোন করা হয়েছে, দেখা যাক তোমার ভাগ্যে কোন হোটেল জুটল।’

কর্নেল শেখ ঘরে ঢুকবার সময় রাহাত খানের কথার শেষটুকু শুনে রানার দিকে চেয়ে একটু হাসল। তারপর বলল, ‘হোটেল মিসখা। চেনেন?’

‘চিনি। স্টেশন রোডে, রেস্ট হাউসের ঠিক উল্টো দিকে, সিনেমা হলটার পাশে,’ বলল রানা।

‘হাঁ। মিসখার পাঁচতলায় দশ নম্বর এয়ার কণ্ডিশনড রুম বুক করা আছে। মিস্টার অ্যাণ্ড মিসেস মাসুদ রানা, থুড়ি, সুবীর সেনের নামে। রানার পাশে একটা চেয়ারে সশব্দে বসল প্রকাণ্ড দেহী কর্নেল শেখ। যেমন উচ্চতা তেমনি প্রস্থ। খাস মুলতানী। নিজ রসিকতায় নিজেই খুশি হয়ে হাততালি দিতে চায়।

‘মিসখা এয়ার কণ্ডিশন করেছে নাকি?’ জিজ্ঞেস করলেন রাহাত খান।

‘না, স্যর, কোনও কোনও ঘরে এয়ার কুলার লাগিয়ে দিয়ে দশ টাকা চার্জ বেশি নেয়।’

‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম, রানা,’ কাজের কথায় এলেন আবার খান সাহেব, ‘তোমরা পৌঁছবে সেখানে সন্ধ্যে সোয়া সাতটার দিকে। মেয়েটা যখনই প্যাকেটগুলো পৌঁছবার জন্যে নীচে নামবে লিফটে করে, তুমি সঙ্গে সঙ্গে নেমে আসবে সিঁড়ি বেয়ে। সামনের রাস্তাটা পার হয়েই দেখবে চালকবিহীন একটা নীল রঙের ওপেল রেকর্ড স্টার্ট দেয়া অবস্থায় রাখা আছে রাস্তার উপর। ওই গাড়িতে করে পিছু নেবে মেয়েটির। এরপর কীভাবে এগোবে তা স্থির করার ভার তোমার উপরই থাকবে। চিটাগাং-ঢাকা ডাইরেক্ট টেলিফোন লাইন থাকায় তোমার সঙ্গে আর ওয়্যারলেস সেট দিচ্ছি না। যখনই প্রয়োজন তখনই রিং করবে।’

ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে উঠতে যাচ্ছিল রানা, চোখের পাতা নামালেন। এবং সেই সঙ্গে তর্জনী দিয়ে সিগারেটের উপর লম্বালম্বিভাবে একটা টোকা দিয়ে ছাই ঝাড়লেন খান সাহেব। তার মানে ‘উঠো না, আর একটু বসো।’ শেষ একটা টান দিয়ে অ্যাশট্রেতে সিগারেটের টুকরোটা ফেলে বোতাম টিপলেন রাহাত খান। উপরের পাতাটা দু’ভাগ হয়ে ভিতরে চলে গেল টুকরোটা। ছাৎ করে একটা শব্দ হলো ভিতর থেকে, আর পাতলা এক ফালি ধোয়া বেরিয়ে এল কোনও এক ফাঁক গলে।

‘আর একটা কথা,’ এতক্ষণ পর আন্তরিকতার ক্ষীণ একটু হাসির আভাস পাওয়া গেল রাহাত খানের মুখে, বলা যায় না, আমাদের অজ্ঞাতে কোনও উপায়ে অপরপক্ষ জেনে ফেলতে পারে যে তুমি সুবীর সেন নও। হয়ত এখুনি সবকিছু জেনে ফেলেছে ওরা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে। বিপদের ঝুঁকিটা কতখানি বুঝতে পারছ তো? কাজেই খুব সাবধান থাকবে। আর সব রকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকবে। যাও এখন।’

কথাগুলো শোনাল, ছোটকালে বাইরে কোথাও পাঠালে মা যেমন বারবার করে বলে দেন, ‘দেখিস খোকা, গাড়ি ঘোড়া দেখে চলিস। আর রাস্তার ডানধার ঘেঁষে হাঁটবি, বুঝলি?’ ঠিক তেমনি।

মৃদু হেসে রানা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। হঠাৎ যদি ও পিছন ফিরত, তা হলে দেখতে পেত তার সুঠাম দীর্ঘ একহারা চেহারার দিকে সস্নেহ দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন মেজর জেনারেল (অব) রাহাত খান।