» » একবিংশতিতম পরিচ্ছেদ : সেকালে যেমন ছিল

কালাদীঘির ডাকাইতির পর আমার অদৃষ্টে যাহা ঘটিয়াছিল, স্বামী মহাশয় এক্ষণে আমার কাছে সব শুনিলেন। রমণ বাবু ও সুভাষিণী যেরূপ ষড়‍‍যন্ত্র করিয়া তাঁহাকে কলিকাতায় লইয়া গিয়াছিল, তাহাও শুনিলেন। একটু রাগও করিলেন। বলিলেন, “আমাকে এত ঘুরাইবার ফিরাইবার প্রয়োজনটা কি ছিল?” প্রয়োজনটা কি ছিল, তাহাও বুঝাইলাম। তিনি সন্তুষ্ট হইলেন। কিন্তু কামিনী সন্তুষ্ট হইল না। কামিনী বলিল, “তোমায় ঘানিগাছে ঘুরায় নাই, অমনি ছাড়িয়াছে, এইটুকু দিদির দোষ। আবার আবদা।র নিলেন কিনা, গ্রহণ করব না! আরে মিন্প‍সে, যখন আমাদের আলতাী-পরা শ্রীপাদপদ্মখানি ভিন্ন তোমার জেতের গতিমুক্তি নাই, তখন অত বড়াই কেন?”

উ-বাবু এবার একটা উতোর মারিলেন, বলিলেন, “তখন চিনিতে পারি নে যে! তোমাদের কি চিনতে জোওয়ায়?”

কামিনী বলিল, “তুমি যে চিনিবে, বিধাতা তা কপালে লিখেন নাই। যাত্রায় শোন নি? বলে,

ধবলী বলিল শ্যাম, কে চেনে তোমারে!
চিনি শুধু কাঁচা ঘাস যমুনার ধারে॥
পদচিহ্ন খুঁজি তব, বংশী শুনে কাণে।
ধ্বজবজ্রাঙ্কুশ তায়, গোরু কি তা জানে?

আমি আর হাসি রাখিতে পারিলাম না। উ-বাবু অপ্রতিভ হইয়া কামিনীকে বলিলেন, “যা ভাই, আর জ্বালাস্ নে! যাত্রা করলি, তার জন্য এই পানের খিলিটা প্যালা নিয়ে যা।”

কামিনী বলিল, “ও দিদি! মিত্রজার একটু বুদ্ধিও আছে দেখিতে পাই।”

আমি। কি বুদ্ধি দেখিলি?

কা। বাবু পানের ঠিলিটা রেখে খিলিটা দিয়েছেন, বুদ্ধি নয়? তা তুই এক কাজ করিস; মধ্যে মধ্যে তোর পায়ে হাত দিতে দিস—তা হলে হাত দরাজ হবে।

আমি। আমি কি ওঁকে পায়ে হাত দিতে, দিতে পারি? উনি হলেন আমার পতিদেবতা।

কা। দেবতা কবে হলেন? পতি যদি দেবতা, তবে এত দিন ত তোমার কাছে উনি উপদেবতাই ছিলেন।

আমি। দেবতা হয়েছেন, যবে ওঁর বিদ্যাধরী গিয়েছে।

কা। আহা, বিদ্যাকে ধরি ধরি করেও ধরতে পারলেন না! তা দেখ মিত্র মহাশয়, তোমার যে বিদ্যা তাহার সঙ্গে ধরাধরি না থাকিলেই ভাল। সে বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা।

আমি। কামিনী, তুই বড় বাড়ালি! শেষ চুরি চামারি পর্যন্ত ঘাড়ে ফেলিতেছিস?

কা। অপরাধ আমার? যখন মিত্র মহাশয় কমিসেরিয়েটের কাজ করেছেন, তখন চুরি ত করেছেন। আর চামারি;–তা যখন রসদ যুগিয়েছেন, তখন চামারিও করেছেন।

উ-বাবু বলিলেন, “বলুগ গে ছেলেমানুষ। অমৃতং বালভাষিতং।”

কা। কাজেই। তুমি যখন বিদ্যাধরী শাসিতং, তখন তোমার বুদ্ধি নাশিতং আমি তবে আসিতং— মা ডাকিতং।

বাস্তবিক মা ডাকিতেছিলেন।

কামিনী মার কাছ হইতে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “জান, কেন মা ডাকিতং? তোমরা আর দুদিন থাকিতং—যদি না থাকিতং, তবে জোর করে রাখিতং।”

আমরা পরস্পরের মুখ পানে চাহিলাম।

কামিনী বলিল, “কেন পরস্পর তাকিতং?”

উ-বাবু বলিলেন, “ভাবিতং।”

কামিনী বলিল, “বাড়ী গিয়া ভাবিতং। এখন দুই দিন এখানে খাবিতং, দাবিতং, হাসিতং, খুসিতং, খেলিতং, ধুলিতং, হেলিতং, দুলিতং, নাচিতং, গায়িতং—”

উ-বাবু বলিলেন, “কামিনী, তুই নাচবি?”

কা। দূর, আমি কেন? আমি যে শিকল কিনে রেখেছি—তুমি নাচবে।

উ-বাবু। আমাকে ত আসা পর্যন্ত নাচাচ্চ; আর কত নাচাবে—আজ তুমি একটু নাচবে।

কা। তা হলে থাকিবে?

উ-বাবু। থাকিব।

কামিনীর নাচ দেখিবার প্রত্যাশায় নহে, আমার পিতামাতার অনুরোধে উ-বাবু আর এক দিন থাকিতে সম্মত হইলেন। সেদিনও বড় আনন্দে গেল। দলে দলে পাড়ার মেয়েরা আসিয়া, সন্ধ্যার পর আমার স্বামীকে ঘেরিয়া লইয়া মজলিস করিয়া বসিল। সেই প্রকাণ্ড পুরীর একটা কোণের ঘরে মেয়েদের মজলিস হইল।

কত মেয়ে আসিল, তার সংখ্যা নাই। কত বড় বড় পটোল-চেরা ভ্রমর-তারা চোখ, সারি বাঁধিয়া, স্বচ্ছ সরোবরে সফরীর মত খেলিতে লাগিল; কত কালো কালো কুণ্ডলী-করা ফণা-ধরা অলকারাশি বর্ষাকালে বনের লতার মত ঘুরিয়া ঘুরিয়া, ফুলিয়া ফুলিয়া, দুলিয়া উঠিতে লাগিল,– যেন কালিয়দমনে কালনাগিনীর দল, বিত্রস্ত হইয়া যমুনার জলে ঘুরিতে ফিরিতেছে—কত কাণ, কাণবালা,চৌদান,মাকড়ি,ঝুমকা,ইয়ার‍রিং,দুল—মেঘমধ্যে বিদ্যুতের মত, কত মেঘের মত চুলের রাশির ভিতরে হইতে খেলিতে লাগিল—কত রাঙ্গা ঠোটের ভিতর হইতে কত মুক্তাপংক্তির মত দন্তশ্রেণীতে কত সুগন্ধি-তাম্বুল চর্বণে কত রকম অধরলীলার তরঙ্গ উঠিতে লাগিল;–কত প্রৌঢ়ার ফাঁদিনথের ফাঁদে কন্দর্পঠাকুর ধরা পড়িয়া, তীরন্দাজিতে জবাব দিয়া নিষ্কৃতি পাইলেন—কত অলঙ্কাররাশিভূষিত সুগোল বাহুর উৎক্ষেপনিক্ষেপে বায়ুসন্তাড়িত পুষ্পিত লতাপূর্ণ উদ্যানের মত সেই কক্ষ একটা অলৌকিক চঞ্চল শোভায় শোভিত হইতে লাগিল, রুণু রুণু ঝুনু ঝুনু শিঞ্জিতে ভ্রমরগুঞ্জন অনুকৃত হইতে লাগিল; কত চিকে চিক চিক; হারে বাহার; চন্দ্রহারে চন্দ্রের হার; মলের ঝলমলে চরণ টল্ো‍মল্! কত বানারসী, বালুচরী, মৃজাপুরী, ঢাকাই, শান্তিপুরে, সিমলা, ফরাসডাঙ্গা–চেলি, গরদ, সূতা—রঙ্গকরা, রঙ্গভরা, ডুরে, ফুর্ফুারে, ঝুর্ঝু রে, বাঁদুরে—তাতে কারও ঘোমটা, কারও আড়ঘোমটা, কারও আধঘোমটা—কারও কেবল কবরীপ্রান্তে মাত্র বসনসংস্পর্শ—কারও তাতেও ভুল। আমার প্রাণনাথ অনেক গোরার পল্টন ফতে করিয়া ঘরে টাকা লইয়া আসিয়াছেন—অনেক কর্ণেল, জান‍‍রেলের বুদ্ধিভ্রংশ করিয়া, লাভের অংশ ঘরে লইয়া আসিয়াছেন—কিন্তু এই সুন্দরীর পল্টন দেখিয়া, তিনি বিশুষ্ক—বিত্রস্ত। তোপের আগুনের স্থানে নয়নবহ্নির স্ফূর্তি-কামানের কালকরালকুণ্ডলীকৃত ধূমপুঞ্জের পরিবর্তে এই কালকরালকুণ্ডলীকৃত কমনীয় কেশকাদম্বিনী, বেওনেটের ঠন্ঠ্নির পরিবর্তে এই অলঙ্কারের রুণরুণি; জয়ঢাকের বাদ্যের পরিবর্তে আলতা-পরা পায়ে মলের ঝম্ঝেমি! যে পুরুষ চিলিয়ানওয়ালা দেখিয়াছে—সেও হতাশ্বাস। এ ঘোর রণক্ষেত্রে তাঁহাকে রক্ষা করিবার জন্য, তিনি আমাকে দ্বারদেশে দেখিতে পাইয়া ইঙ্গিতে ডাকিলেন—কিন্তু আমিও শিখ সেনাপতির মত, বিশ্বাসঘাতকতা করিলাম—এ রণে তাঁহার সাহায্য করিলাম না।

আমরা পরস্পরের মুখ পানে চাহিলাম।

কামিনী বলিল, “কেন পরস্পর তাকিতং?”

উ-বাবু বলিলেন, “ভাবিতং।”

কামিনী বলিল, “বাড়ী গিয়া ভাবিতং। এখন দুই দিন এখানে খাবিতং, দাবিতং, হাসিতং, খুসিতং, খেলিতং, ধুলিতং, হেলিতং, দুলিতং, নাচিতং, গায়িতং—”

উ-বাবু বলিলেন, “কামিনী, তুই নাচবি?”

কা। দূর, আমি কেন? আমি যে শিকল কিনে রেখেছি—তুমি নাচবে।

উ-বাবু। আমাকে ত আসা পর্যন্ত নাচাচ্চ; আর কত নাচাবে—আজ তুমি একটু নাচবে।

কা। তা হলে থাকিবে?

উ-বাবু। থাকিব।

কামিনীর নাচ দেখিবার প্রত্যাশায় নহে, আমার পিতামাতার অনুরোধে উ-বাবু আর এক দিন থাকিতে সম্মত হইলেন। সেদিনও বড় আনন্দে গেল। দলে দলে পাড়ার মেয়েরা আসিয়া, সন্ধ্যার পর আমার স্বামীকে ঘেরিয়া লইয়া মজলিস করিয়া বসিল। সেই প্রকাণ্ড পুরীর একটা কোণের ঘরে মেয়েদের মজলিস হইল।

কত মেয়ে আসিল, তার সংখ্যা নাই। কত বড় বড় পটোল-চেরা ভ্রমর-তারা চোখ, সারি বাঁধিয়া, স্বচ্ছ সরোবরে সফরীর মত খেলিতে লাগিল; কত কালো কালো কুণ্ডলী-করা ফণা-ধরা অলকারাশি বর্ষাকালে বনের লতার মত ঘুরিয়া ঘুরিয়া, ফুলিয়া ফুলিয়া, দুলিয়া উঠিতে লাগিল,– যেন কালিয়দমনে কালনাগিনীর দল, বিত্রস্ত হইয়া যমুনার জলে ঘুরিতে ফিরিতেছে—কত কাণ, কাণবালা, চৌদান, মাকড়ি, ঝুমকা, ইয়ার‍রিং, দুল—মেঘমধ্যে বিদ্যুতের মত, কত মেঘের মত চুলের রাশির ভিতরে হইতে খেলিতে লাগিল—কত রাঙ্গা ঠোঁটের ভিতর হইতে কত মুক্তাপংক্তির মত দন্তশ্রেণীতে কত সুগন্ধি-তাম্বুল চর্বণে কত রকম অধরলীলার তরঙ্গ উঠিতে লাগিল;—কত প্রৌঢ়ার ফাঁদিনথের ফাঁদে কন্দর্পঠাকুর ধরা পড়িয়া, তীরন্দাজিতে জবাব দিয়া নিষ্কৃতি পাইলেন—কত অলঙ্কাররাশিভূষিত সুগোল বাহুর উৎক্ষেপনিক্ষেপে বায়ুসন্তাড়িত পুষ্পিত লতাপূর্ণ উদ্যানের মত সেই কক্ষ একটা অলৌকিক চঞ্চল শোভায় শোভিত হইতে লাগিল, রুণু রুণু ঝুনু ঝুনু শিঞ্জিতে ভ্রমরগুঞ্জন অনুকৃত হইতে লাগিল; কত চিকে চিক চিক; হারে বাহার; চন্দ্রহারে চন্দ্রের হার; মলের ঝলমলে চরণ টল্‌মল! কত বানারসী, বালুচরী, মৃজাপুরী, ঢাকাই, শান্তিপুরে, সিমলা, ফরাসডাঙ্গা–চেলি, গরদ, সূতা—রঙ্গকরা, রঙ্গভরা, ডুরে, ফুর্ফুারে, ঝুর্ঝু রে, বাঁদুরে—তাতে কারও ঘোমটা, কারও আড়ঘোমটা, কারও আধঘোমটা—কারও কেবল কবরীপ্রান্তে মাত্র বসনসংস্পর্শ—কারও তাতেও ভুল। আমার প্রাণনাথ অনেক গোরার পল্টন ফতে করিয়া ঘরে টাকা লইয়া আসিয়াছেন—অনেক কর্ণেল, জান‍‍রেলের বুদ্ধিভ্রংশ করিয়া, লাভের অংশ ঘরে লইয়া আসিয়াছেন—কিন্তু এই সুন্দরীর পল্টন দেখিয়া, তিনি বিশুষ্ক—বিত্রস্ত। তোপের আগুনের স্থানে নয়নবহ্নির স্ফূর্তি-কামানের কালকরালকুণ্ডলীকৃত ধূমপুঞ্জের পরিবর্তে এই কালকরালকুণ্ডলীকৃত কমনীয় কেশকাদম্বিনী, বেওনেটের ঠন্ঠ্নির পরিবর্তে এই অলঙ্কারের রুণরুণি; জয়ঢাকের বাদ্যের পরিবর্তে আলতা-পরা পায়ে মলের ঝম্ঝেমি! যে পুরুষ চিলিয়ানওয়ালা দেখিয়াছে—সেও হতাশ্বাস। এ ঘোর রণক্ষেত্রে তাঁহাকে রক্ষা করিবার জন্য, তিনি আমাকে দ্বারদেশে দেখিতে পাইয়া ইঙ্গিতে ডাকিলেন—কিন্তু আমিও শিখ সেনাপতির মত, বিশ্বাসঘাতকতা করিলাম—এ রণে তাঁহার সাহায্য করিলাম না।

যমুনা ঠাকুরাণী “মহিষী” শব্দের অর্থবোধে যেমন পণ্ডিতা, “পুলিন” শব্দের অর্থবোধেও সেইরূপ। তিনি ভাবিলেন, আমি বুঝি কোন পুলিনবিহারীর কথার ইঙ্গিত করিয়া তাঁহার অকলঙ্কিত সতীত্বের-(অকলঙ্কিত তাঁহার রূপের প্রভাবে)—প্রতি কোনপ্রকার ইঙ্গিত করিয়াছি। তিনি সক্রোধে বলিলেন, “এর ভিতর পুলিন কে লো?”

কাজেই আমারও একটু রঙ্গ চড়াইতে ইচ্ছা হইল। আমি বলিলাম, “যার গায়ে পড়িয়া যমুনা রাত্রিদিন তরঙ্গভঙ্গ করে, বৃন্দাবন তাকে পুলিন বলে।”

আবার তরঙ্গভঙ্গে সর্বনাশ করিল,–যমুনা দিদি ত কিছু বুঝিল না, রাগিয়া বলিল, “তোর তরঙ্গ ফরঙ্গকেও চিনি নে, তোর পুলিনকেও চিনি নে, তোর বেন্দাবনকে চিনি নে। তুই বুঝি ডাকাতের কাছে এত সব রঙ্গরসের নাম শিখে এসেছিস?”

মজলিসের ভিতর রঙ্গময়ী বলিয়া আমার একজন সমবয়স্কা ছিল। সে বলিল, “অত ক্ষেপ কেন যমুনা দিদি! পুলিন বলে নদীর ধারের চড়াকে। তোমার দু ধারে কি চড়া আছে?”

চঞ্চলা নামে যমুনা দিদির ভাইজ, ঘোমটা দিয়া পিছনে বসিয়াছিল, সে ঘোমটার ভিতর হইতে মৃদু মধুর স্বরে বলিল, “চড়া থাকিলেও বাঁচিতাম! একটু ফরসা কিছু দেখিতে পাইতাম। এখন কেবল কালো জলের কালিন্দী কল কল করিতেছে।”

কামিনী বলিল, “আমার যমুনা দিদিকে কেন তোরা অমন করে চড়ার মাঝখানে ফেলে দিতেছিস!”

চঞ্চলা বলিল, “বালাই! ষাট! ঠাকুরঝিকে চড়ার মাঝখানে ফেলে দেব কেন? ওঁর ভাইয়ের পায়ে ধরে বলব, যেন ঠাকুরঝিকে মেঠো শ্মশানে দেন।”

রঙ্গময়ী বলিল, “দুটোতে তফাৎ কি বৌ?”

চঞ্চলা বলিল, “শ্মশানে শিয়াল কুকুরের উপকার;–চড়ায় গোরু মহিষচরে—তাদের কি উপকার?” মহিষ কথাটা বলিবার সময়ে, বৌ একবার ঘোমটা তুলিয়া ননদের উপর সহাস্যে কটাক্ষ করিল।

যমুনা বলিল, “নে, আর এক-শবার সেই কথা ভাল লাগে না। যদের মোষ ভাল লাগে, তারাই এক-শবার মোষ মোষ করুগ গে।”

পিয়ারী ঠান‍‍দিদি কথাটায় বড় কাণ দেন নাই—তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “মোষের কথা কি গা?” কামিনী বলিল, “কোন্ দেশে তেলিদের বাড়ী মোষে ঘানি টানে, সেই কথা হ’চ্ছে।”

এই বলিয়া কামিনী পলাইল। বার বার সেই তেলি কথাটা মনে করিয়া দেওয়াটা ভাল হয় নাই—কিন্তু কামিনী কুচরিত্রা লোক দেখিতে পারিত না। পিয়ারী ঠান‍দিদি, রাগে অন্ধকার দেখিয়া আর কথা না কহিয়া উ-বাবুর কাছে গিয়া বসিল। আমি তখন কামিনীকে ডাকিয়া বলিলাম, “কামিনী! দেখ‍‍সে আয় লো! এইবার পিয়ারী কৃষ্ণ পেয়েছেন।”

কামিনী দূর হইতেই বলিল, “অনেকদিন সময় হয়েছে।”

তার পর একটা সোরগোল শুনিলাম। আমার স্বামীর আওয়াজ শুনিতে পাইলাম—তিনি একজনকে হিন্দিতে ধমকধামক করিতেছেন। আমরা দেখিতে গেলাম। দেখিলাম, একজন দাড়িওয়ালা মোগল ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছে; উ-বাবু তাহাকে তাড়াইবার জন্য ধমকধামক করিতেছেন, মোগল যাইতেছে না। কামিনী তখন দ্বার হইতে ডাকিয়া বলিল, “মিত্র মহাশয়! গায়ে কি জোর নেই?”

মিত্র মহাশয় বলিলেন, “আছে বই কি?”

কামিনী বলিল, “তবে মোগল মি‍ন্‌সেকে গলা ধাক্কা দিয়া ঠেলিয়া দাও না।”

এই বলিবা মাত্র মোগল ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল। পলায়ন করিবার সময় আমি তাহার দাড়ি ধরিলাম—পরচুলা খসিয়া আসিল। মোগল বলিল, “মরণ আর কি! তা এ বোকাটি নিয়ে ঘর করিবি কি প্রকারে?” এই বলিয়া সে পলাইল। আমি দাড়িটা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া যমুনা দিদিকে উপহার দিলাম। উ-বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “ব্যাপার কি?”

কামিনী বলিল, “ব্যাপার আর কি? তুমিই দাড়িটা পরিয়া চারি পায়ে ঘাসবনে চরিতে আরম্ভ কর।”

উ-বাবু বলিলেন, “কেন, মোগল কি জাল?”

কা। কার সাধ্য এমন কথা বলে! শ্রীমতী অনঙ্গমোহিনী দাসী কি জাল মোগল হইতে পারে! আসল দিল্লীর আমদানি।

একটা ভারি হাসি পড়িয়া গেল। আমি একটু মনঃক্ষুণ্ণ হইয়া চলিয়া আসিতেছিলাম, এমন সময়ে পাড়ার ব্রজসুন্দরী দাসী একখানি জীর্ণ বস্ত্র পরিয়া একটি ছেলে কোলে করিয়া উ-বাবুর কাছে গিয়া দুঃখের কান্না কাঁদিতে লাগিল। “আমি বড় গরীব; খেতে পাই না; ছেলেটি মানুষ করিতে পারি না।” উ-বাবু তাহাকে কিছু দিলেন। আমরা দুইজনে দ্বারের দুই পাশে। সে যখন দ্বার পার হয়, কামিনী তাহাকে বলিল, “ভাই ভিখারিণি! জান ত বড় মানুষের কাছে কিছু ভিক্ষা পাইলে দ্বারবান‍দের কিছু ঘুস দিয়ে যেতে হয়?”

ব্রজসুন্দরী বলিল, “দ্বারবান কে?”

কা। আমরা দুইজন।

ব্র। কত ভাগ চাও?

কামিনী। পেয়েছ কি?

ব্র। দশটি টাকা।

কা। তবে, আমাদের আট টাকা আট টাকা ষোল টাকা দিয়া যাও।

ব্র। লাভ মন্দ নয়!

কা। তা বড় মানুষের বাড়ীর ভিক্ষায় লাভালাভ ধরিতে গেলে চলিবে কেন? সময়ে অসময়ে ঘর থেকেও কিছু দিতে হয়।

ব্রজসুন্দরী বড় মানুষের স্ত্রী। ধাঁ করিয়া ষোল টাকা বাহির করিয়া দিল। আমরা সেই ষোল টাকা যমুনা ঠাকুরাণীকে দিলাম, বলিলাম, “তোমরা এই টাকায় সন্দেশ খাইও।”

স্বামী বলিলেন, “ব্যাপার কি?”

ততক্ষণে ব্রজসুন্দরী ছেলে পাঠাইয়া দিয়া, বানারসী পরিয়া আসিয়া বসিলেন। আবার একটা হাসির ঘটা পড়িয়া গেল।

উ-বাবু বলিলেন, “এ কি যাত্রা নাকি?”

যমুনা বলিল, “তা না ত কি? দেখিতেছ না, কাহারও কালিয়দমনের পালা, কারও কলঙ্কভঞ্জনের পালা, কারও মাথুর মিলন,–কারও শুধু পালাই পালাই পালা।”

উ-বাবু। শুধু পালাই পালাই পালা কার?

য। কেন কামিনীর! কেবল পালাই পালাই তার পালা।

কামিনী কথায় সকলকে জ্বালাইতে লাগিল; পান, পুষ্প, আতর বিলাইয়া সকলকে তুষ্ট করিতেছিল। তখন সকলে মিলিয়া তাহাকে ধরিল, বলিল, “তুই যে বড় পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস লা?”

কামিনী বলিল, “পালাব না ত কি তোমাদের ভয় করি না কি?”

মিত্র মহাশয় বলিলেন, “কামিনী! ভাই, তোমার সঙ্গে কি কথা ছিল?”

কা। কি কথা ছিল, মিত্র মহাশয়?

উ-বাবু। তুমি নাচিবে।

কা। আমি ত নেচেছি।

উ। কখন নাচলে?

কা। দুপুরবেলা।

উ। কোথায় নাচলি লো?

কা। আমার ঘরের ভিতর, দোর বন্ধ করে।

উ। কে দেখেছে?

কা। কেউ না।

উ। তেমনতর ত কথা ছিল না।

কা। এমন কথাও ছিল না যে, তোমাদের সমুখে আসিয়া পেশওয়াজ পরিয়া নাচিব। নাচিব স্বীকার করিয়াছিলাম, তা নাচিয়াছি। আমার কথা রাখিয়াছি। তোমরা দেখিতে পাইলে না, তোমাদের অদৃষ্টের দোষ। এখন আমি যে শিকল কিনিয়া রাখিয়াছি, তার কি হবে?

কামিনী যদি নাচের দায়ে এড়াইল, তবে আমার স্বামী গানের জন্য ধরা পড়িলেন। মজলিস হইতে হুকুম হইল, তোমাকে গায়িতে হইবে। তিনি পশ্চিমাঞ্চলে রীতিমত গীতবিদ্যা শিখিয়াছিলেন। তিনি সনদী খিয়াল গায়িলেন। শুনিয়া সে অপ্সরোমণ্ডলী হাসিল। ফরমায়েস করিল, “বদন অধিকারী, কি দাশু রায়।” তাতে উ-বাবু অপটু। সুতরাং অপ্সরোগণ সন্তুষ্ট হইল না।

এইরূপে দুই প্রহর রাত্রি কাটিল। এ পরিচ্ছেদটা না লিখিলেও লিখিলেও পারিতাম। তবে এ দেশের গ্রাম্য স্ত্রীদিগের জীবনের এই ভাগটুকু এখন লোপ পাইয়াছে বলিয়া আমার বিশ্বাস। লোপ পাইয়াছে, ভালই হইয়াছে; কেন না, ইহার সঙ্গে অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা, কদাচিৎ বা দুর্নীতি, আসিয়া মিশিত। কিন্তু যাহা লোপ পাইয়াছে, তাহার একটি চিত্র দিবার বাসনায়, এই পরিচ্ছেদটা লিখিলাম। তবে জানি না, অনেক স্থানে এ কুরীতি লোপ না পাইয়াও থাকিতে পারে। যদি তাহা হয়, তবে যাঁহারা জামাই দেখিতে পৌরস্ত্রীদিগকে যাইতে নিষেধ করেন না, তাঁহাদের চোখ কাণ ফুটাইয়া দেওয়া প্রয়োজনীয়। তাই ধরি মাছ, না ছুঁই পানি করিয়া, তাঁহাদের ইঙ্গিত করিলাম।

Leave a Reply