আমেরিকা এবং পাশ্চাত্যদেশ সমূহ নিজেদেরকে মানবাধিকারের ঝাণ্ডাবাহী এবং রক্ষক হিসেবে এতটা প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে যে, এর ফলে আমাদের এখানকার মুক্তচিন্তাশীল এবং আধুনিক চিন্তাশীলরা বাস্তবেই মনে করে যে, আমেরিকা এবং পাশ্চাত্য মানবাধিকারের বড় রক্ষক। আসুন ইতিহাসের আয়নায় তা যাচাই করুন যে বাস্তবেই কি তা ঠিক আছে? সর্বপ্রথম আমেরিকার অতীত ইতিহাসে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক।

  1. খৃষ্টীয় ১৮ শতাব্দীতে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গরা নুতন শক্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজেদের “নুতন পৃথিবী” আবাদ করার জন্য ৭০ লক্ষ রেড ইণ্ডিয়ানকে হত্যা করেছিল, আফ্রিকা মহাদেশের কৃষ্ণাঙ্গদেরকে জন্তুর ন্যায় ধরে ধরে নিজেদের ক্রীতদাসে পরিণত করেছিল, জাহাজসমূহে জন্তুর ন্যায় ভরপুর করে আমেরিকায় নিয়ে এসেছিল এবং তাদেরকে বেচা-কিনা করেছিল। এই কৃষ্ণাঙ্গরা আজও আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গদের ন্যায় মর্যদা পায় না। যখনই কৃষ্ণাঙ্গরা আমেরিকার সংবিধানে লিখিত মানবাধিকারের দাবী করেছে তখন তাদেরকে অত্যন্ত নির্মম ভাবে শেষ করে দেয়া হয়েছে।[১]
  2. ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে দক্ষিণ ডকুটা এবং আর্জেনটাইনের উপর অ্যামেরিকা আক্রমণ করে;
  3. ১৮৯১ খৃষ্টাব্দে চিলির উপর আক্রমণ করে;
  4. ১৮৯২ খৃষ্টাব্দে আওয়হুর উপর আক্রমণ করে;
  5. ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে হুয়াইয়ের উপর আক্রমণ করে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহকে শেষ করে দেয়;
  6. ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দে কোরিয়ার উপর;
  7. ১৮৯৫ খৃষ্টাব্দে পানামার উপর;
  8. ১৮৯৬ খৃষ্টাব্দে নাকানা গোয়ার উপর আক্রমণ;
  9. ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দে ফিলিপাইনের উপর আক্রমণ— এ যুদ্ধ ১৯১০ পর্যন্ত (অর্থাৎ ১২ বছর পর্যন্ত) চলছিল, এর ফলে ৬ লক্ষ ফিলিপাইনী মারা যায়;
  10. ১৯১২ খৃষ্টাব্দে কিউবার উপর হামলা;
  11. ১৯১৩ খৃষ্টাব্দে মেক্সিকোর উপর আক্রমণ;
  12. ১৯১৪ খৃষ্টাব্দে হাইতির উপর আক্রমণ;
  13. ১৯১৭-১৯১৮ খৃষ্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে;
  14. ১৯১৯ খৃষ্টাব্দে হোল্ডরিজের উপর আক্রমণ করে;
  15. ১৯২০ খৃষ্টাব্দে গোয়েটির উপর আক্রমণ করে;
  16. ১৯২১ খৃষ্টাব্দে পশ্চিম অর্জিনিয়ার উপর আক্রমণ করে।
  17. ১৯৪১-৪৫ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, এতে চার কোটি লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এতে অ্যামেরিকা অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে এবং তাদের এক কোটি ৬০ লক্ষ সৈন্য তাতে অংশ গ্রহণ করে। হিরুশিমা এবং নাগাসাকীর উপর এটমবোমা নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের মধ্যে মানবাধিকারের পতাকাবাহী অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট টারোমীন এবং সভ্য বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার উন্সটন চার্চেলও ছিল।
  18. ১৯৪৩ খৃষ্টাব্দে ডিউটোরিটে কৃষ্ণাঙ্গদের বিদ্রোহকে দমন করার জন্য অ্যামেরিকা সেনা আক্রমণ করে;
  19. গ্রীসের যুদ্ধস্থান (১৯৪৭-৪৯ খৃষ্টাব্দে ) কমান্ডো আক্রমণ করে;
  20. ১৯৫০ খৃষ্টাব্দে পোরটোএকোরে আক্রমণ করে;
  21. ১৯৫৩ খৃষ্টাব্দে সেনা আক্রমণের মাধ্যমে ইরানের সরকার পরিবর্তন করে।
  22. ১৯৫৪ খৃষ্টাব্দে গোয়েটেমালার উপর বোমা নিক্ষেপ করে।
  23. ১৯৬০ খৃষ্টাব্দে থেকে ১৯৭৫ খৃষ্টাব্দে অ্যামেরিকা ১৫ বছর পর্যন্ত ভিয়েতনামের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, যার ফলে ১০লক্ষ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
  24. ১৯৬৫ খৃষ্টাব্দে অ্যামেরিকা ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান সোহর্তোর বিরোধী পক্ষের ১০লক্ষ লোককে মারার জন্য সহযোগিতা করেছিল।
  25. ১৯৬৯ খৃষ্টাব্দে থেকে১৯৭৫ খৃষ্টাব্দে পর্যন্ত (৬ বছর) কম্বোডিয়ার সাথে যুদ্ধ করেছিল। এতে ২০ লক্ষ লোককে হত্যা করেছে।
  26. ১৯৭১-৭৩ খৃষ্টাব্দে লাউসে বোমা নিক্ষেপ করেছে।
  27. ১৯৭৩ খৃষ্টাব্দে দক্ষিণ ঢেকোটার উপর সেনা আক্রমণ করে।
  28. ১৯৭৩ খৃষ্টাব্দে চিলির উপর সেনা আক্রমণ করে সরকার পরিবর্তন করে।
  29. ১৯৭৬-১৯৯২ খৃষ্টাব্দে এন্‌গোলায় দক্ষিণ আফ্রিকার সহযোগিতায় সংঘঠিত বিদ্রোহীদেরকে সহযোগিতা করে।
  30. ১৯৮১- ৯০ খৃষ্টাব্দে নাকারাগোয়ার উপর সেনা আক্রমণ করে।
  31. ১৯৮২- ৮৪ খৃষ্টাব্দে পর্যন্ত লেবাননের মুসলিম অঞ্চলসমূহে বোমাবাজী করেছে।
  32. ১৯৮৪ খৃষ্টাব্দে পারস্য সাগরে দু’টি ইরানী বিমান ধ্বংস করেছে।
  33. ১৯৮৬ খৃষ্টাব্দে সরকার পরিবর্তনের জন্য লিবিয়ার উপর আক্রমণ করে।
  34. ১৯৭৯ খৃষ্টাব্দে ইরাক অ্যামেরিকার সৈন্যদের সহযোগিতায় ইরানের উপর আক্রমন করে। এ যুদ্ধ ৮ বছর পর্যন্ত চলেছে যার ফলে উভয় পক্ষের লক্ষ লক্ষ লোক ক্ষতি গ্রস্ত হয়েছে।
  35. ১৯৮৯ খৃষ্টাব্দে ফিলিপাইনে সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ হয়, অ্যামেরিকা এ বিদ্রোহ দমন করার জন্য ফিলিপাইনকে আকাশ সীমা দিয়ে সহযোগীতা করেছে।
  36. ১৯৮৯ খৃষ্টাব্দে সেনা আক্রমনের মাধ্যমে পানামার সরকার পরিবর্তন করেছে, যার ফলে ২ হাজার লোক মৃত্যুবরণ করেছে।
  37. ১৯৮৯ খৃষ্টাব্দে আলজেরিয়ার ইসলামিক সালভেশন ফ্রন্ট নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে, যারা দেশে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেল, ইসলামী বিপ্লবকে প্রতিরোধ করার জন্য অ্যামেরিকার সাহায্যে সেনা আক্রমণ চালানো হয়, যার ফলে ৮০ হাজার লোক নিহত হয়েছে।
  38. ১৯৯০ খৃষ্টাব্দে ইরাককে কুয়েতের উপর আক্রমণ করার জন্য উৎসাহিত করে এবং ১৯৯১ খৃষ্টাব্দে ডিজারেট স্টার্ম অপারেশনের আদলে নিজেই ইরাকের উপর আক্রমণ করে, যার ফলে হাজার হাজার ইরাকী মৃত্যুবরণ করে।
  39. ১৯৯০ খৃষ্টাব্দে হাইতির সরকার পরিবর্তন করানোর জন্য সেনা আক্রমন করে।
  40. ১৯৯৬ খৃষ্টাব্দে ইরাকের উপর আক্রমণ করে এবং গুরুত্বপূর্ণ সেনা আস্তানাসমূহে মিসাইল নিক্ষেপ করে। ১৯৯৮ খৃষ্টাব্দে সুদানের দু’টি অস্ত্র কারখানার উপর আক্রমণ করে।
  41. ১৯৯৮- খৃষ্টাব্দে আফগাস্তিানে সি, আই, এর প্রতিষ্ঠিত জিহাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্ৰসমূহে মিজাইল হামলা চালায়;
  42. ১৯৯৮ খৃষ্টাব্দে ইরাকের উপর আবার একাধারে চার দিন মিসাইল আক্রমণ করতে থাকে।
  43. ১৯৯০ খৃষ্টাব্দে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার উপর বিদ্রোহ করায়, খৃষ্টানদেরকে সহযোগিতা করে, লাখ লাখ মুসলমানকে হত্যা করেছে, পরিশেষে পূর্ব তৈমুরকে একটি খৃষ্টান রাষ্ট্র হিসেবে কায়েম করে।[২][৩]
  44. সোভিয়েত ইউনিয়নের জোর পূর্বক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তির জন্য দশ লক্ষ শহীদের কোরবানীর রক্ত না শুকাতেই আফগানিস্তানের উপর ২০০১ খৃষ্টাব্দে বিমান এবং মিসাইল থেকে বোমাবাজী শুরু করে, যার ফলে ২৫ হাজার নিরপরাধ মানুষ শাহাদাত বরণ করে। ৭হাজার মানুষকে বন্দী করা হয়, আর তালেবানের স্থানে উত্তারঞ্চলীয় জোটের পুতুল সরকার কায়েম করা হয়।
  45. ইরাকে পরমানবিক অস্ত্র থাকার বাহানা দিয়ে ২০ মার্চ ২০০৩ খৃষ্টাব্দে অ্যামেরিকা ইরাকের উপর আক্রমণ করে, যার ফলে হাজার হাজার নিরপরাধ লোক নিহত হয়েছে, ইরাকে অ্যামেরিকার নিয়ন্ত্রণ লাভের পর ফালুজা শহরের ঘণবসতিপূর্ণ এলাকায় অ্যামেরিকান সৈন্যরা বিষাক্ত গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং রাসায়নিক অস্ত্রও ব্যবহার করেছে, যা ব্যবহারে জাতিসঙ্গের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
  46. ২০০৬ খৃষ্টাব্দে জানুয়ারিতে ফিলিস্তিনের সাধারণ নির্বাচনে হামাস বিজয় লাভ করে, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের পতাকাবাহী অ্যামেরিকা হামাসের সরকারকেই মেনে নিতে অস্বীকার করে নি বরং তাদেরকে খতম করার জন্য একের পর এক পরিকল্পনাও নিতে থাকে।
  47. ইরানে আহমদ নাযাদের সরকার যেহেতু অ্যামেরিকাকে নিজের মনিব হিসেবে দেখছে না, তাই অ্যামেরিকা এখন রাত দিন সেখানে হামলা করার বাহানা খোঁজছে।
  48. নামে মাত্র সন্ত্রাসবাদ খতম করার অজুহাতে পাকিস্তান অ্যামেরিকার বন্ধু হওয়া সত্বেও ডজন বারের বেশি পাকিস্তানের আকাশ সীমা পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্যবহার করে পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে চেলেঞ্জ করেছে।

আসুন একবার ১৪ শত বছর আগের মানবাধিকার সম্পর্কে ইসলামের দিকনির্দেশনার কিছু দৃষ্টান্ত নেয়া যাক, এরপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন যে, মানবাধিকারের দাবীতে কে সত্যবাদী আর কে মিত্যাবাদী?

  1. বিদায় হজ্বের সময় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভাষণ দিতে গিয়ে, মানুষকে মানবাধিকার সম্পর্কে বলতে গিয়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক অর্থবোধক এক বক্তব্য পেশ করেছেন যে, কিয়ামত পর্যন্ত এর বিকল্প কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। অ্যামেরিকা এবং প্রাচ্যবাসীরা যখন একান্তচিত্তে কোন সময় তা অধ্যায়ন করবে এবং এ অনুযায়ী আমল করার সিদ্ধান্ত নিবে, তাহলে নিঃসন্দেহে ঐ দিন থেকেই বিশ্বব্যাপী শান্তি ও নিরাপত্তার সয়লাভ হয়ে যাবে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন— হে মানব মণ্ডলী! নিশ্চয় তোমাদের রব একক, তোমাদের পিতাও একজন।

    শুনে রাখ কোন আরাবীর অনারবীর উপর এবং কোন অনারবীর কোন আরাবীর উপর কোন বিশেষ মর্যাদা নেই, না কোন লাল বর্ণের অধিকারী কোন কৃষ্ণাঙ্গের উপর, না কোন কৃষ্ণাঙ্গের কোন লাল বর্ণের অধিকারীর উপর কোন বিশেষ মর্যাদা রয়েছে, তবে (তাদের মাঝে) মর্যাদার (মাপকাঠি) হবে তাকওয়ার ভিত্তিতে। (মুসনাদ আহমদ)

    তিনি অন্যত্র আরেকটি বক্তব্যে বলেছেন— হে মানব মণ্ডলী! তোমাদের রক্ত, সম্পদ, সম্মান একে অপরের উপর সর্বদাই হারাম, এ বিষয়গুলো তোমাদের জন্য এমনি মর্যাদাবান যেমন আজকের দিন (১০ যিলহাজ্জ্ব) এবং যেমন এই শহর (মক্কা) তোমাদের নিকট মর্যাদাবান। (বোখারী, আবুদাউদ, নাসায়ী)।

  2. মানুষের জানের নিরাপত্তাকে সুদৃঢ় করার জন্য এতটুকু সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, যে ব্যক্তি লোহার অস্ত্র দিয়ে তার ভাইয়ের প্রতি ইঙ্গিত করবে তার উপর ফেরেশ্তা ততক্ষণ পর্যন্ত অভিসম্পাত করতে থাকবে যতক্ষণ না সে তা থেকে বিরত হবে। চাই সে তার আপন ভাই হোক বা যে ধরণের ভাই হোক না কেন। (মুসলিম)
  3. অমুসলিমদের জীবনের নিরাপত্তা বিধানকে নিশ্চিত করতে গিয়ে বলা হয়েছে— যে ব্যক্তি কোন যিম্মীকে (ইসলামী রাষ্ট্রে বিধর্মী প্রজা) বিনা কারণে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুঘ্রাণ পাবে না। (বোখারী)
  4. যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবাগণকে এ নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন যেন নিহতদেরকে মোসলা (নাক, কান) কর্তন না করা হয়। শত্রুকে ধোঁকা দিয়ে হত্যা করা যাবে না; শত্রুকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে হত্যা করা যাবে না; শত্রুকে নিরাপত্তা দেয়ার পর তাকে হত্যা করা যাবে না; নারী, শিশু, শ্রমিক, ইবাদতকারীদেরকে হত্যা করা যাবে না; ফলবান বৃক্ষ কাটা যাবে না; চতুপদ জন্তু হত্যা করা যাবে না; অঙ্গীকার ভঙ্গ করা যাবে না; যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে তাদের জান মালের নিরাপত্তা ঐভাবে দিতে হবে যেভাবে মুসলমানদের জানমালের নিরপত্তা বিধান করা হয়ে থাকে। ( বোখারী, মোয়ত্বা, আবুদাউদ, ইবনু মাযা)

ইসলামের এ দিক নির্দেশনা শুধু মৌখিকই ছিল না বরং মুসলমানরা সর্বকালে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে এ দিক নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছে।

আমরা এখানে উদাহরণ সরূপ কিছু ঘটনা উল্লেখ করতে চাই—

  1. ৮ম হিযরীর শা’বান মাসে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খালেদ বিন ওলীদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে এক কাবিলা (বংশের) লোকদেরকে দাওয়াত দেয়ার জন্য পাঠালেন, ভুল বুঝাবুঝির ভিত্তিতে কিছু সংখ্যক লোককে কাফের মনে করে হত্যা করা হল, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন বিষয়টি জানতে পারলেন তখন উভয় হাত তুলে দোয়া করলেন “হে আল্লাহ্ খালেদ যা করেছে তা থেকে আমি দায়িত্ব মুক্ত। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিহতদের রক্ত পণ এবং অন্যান্য ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন।
  2. ৪র্থ হিযরীর সফর মাসে বি’রে মাউনার বেদনাদায়ক ঘটনার পর, যেখানে আমর বিন উমাইয়া জমেরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন, মদীনায় ফিরে আসার সময় রাস্তায় কিলাব বংশের দু’ব্যক্তিকে শত্রু পক্ষের লোক মনে করে হত্যা করেছিল, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ ঘটনা জানতে পেরে তিনি তাদের উভয়ের রক্তপণ আদায় করেন।
  3. ২য় হিযরীর রজব মাসে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি গোয়েন্দা দল সংবাদ সংগ্রহের জন্য পাঠালেন, যাদের কোরাইশদের একটি গ্রুপের সাথে সংঘর্ষ হল, সাহাবাগণ নিজেদের মাঝে পরামর্শক্রমে কোরাইশদের গ্রুপটির উপর আক্রমণ করল, ফলে কোরাইশদের এক ব্যক্তি নিহত হল, দু’জন গ্রেফতার হল, একজন পালিয়ে গিয়েছিল, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ ঘটনা জানতে পেরে বললেন— আমি তোমাদেরকে হারাম (নিষিদ্ধ মাসে) যুদ্ধ করার অনুমতি দেই নি, ফলে তিনি দু’জন বন্দীকেই মুক্তি দিয়ে দিলেন এবং নিহত ব্যক্তির রক্তপণ আদায় করলেন।
  4. বদরের যুদ্ধে মক্কার মোশরেকদের ৭০জন লোক বন্দী হয়েছিল, এরা মুসলমানদের জানের শত্রু ছিল, মুসলমানদেরকে পৃথিবী থেকে চির বিদায় করে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু যখন বন্দী হয়ে আসল, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবাগণকে নির্দেশ দিলেন যে বন্দীদের সাথে ভাল আচরণ করবে, তাই সাহাবাগণ নিজেরা খেজুর খেত, আর বন্দীদেরকে ভাল খাবার পরিবেশন করত, যে সমস্ত বন্দীদের কাপড় ছিল না তাদের জন্য কাপড়ের ব্যবস্থা করা হল, বন্দীদের মধ্যে এক ব্যক্তির নাম ছিল সুহাইল বিন আমর, যে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে রক্ত গরম করা বক্তব্য দিত, ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) পরামর্শ দিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ তার সামনের দু’টি দাঁত ভেঙ্গে দিন, যাতে আর কোন দিন আপনার বিরুদ্ধে কিছু বলতে না পারে। শাস্তি দেয়ার উপযুক্ত পরামর্শ ছিল, সামনে কোন বাধাও ছিল না, বিশ্ববাসীর প্রতি রহমতের নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-র পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে বন্দীদের সাথে সদাচারণের এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন যা পৃথিবীতে আজও অতুলনীয়।
  5. বদরের যুদ্ধের বন্দীদের মাঝে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জামাতা আবুল আসও ছিল, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মেয়ে যায়নাব (রাযিয়াল্লাহু আনহা) আবুল আসের মুক্তির জন্য কিছু সম্পদ পাঠাল, যার মধ্যে একটি হারও ছিল যা খাদীজা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তার মেয়েকে বিদায় দেওয়ার সময় দিয়েছিল, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঐ হার দেখা মাত্র মন নরম হয়ে গেল, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবাগণকে বললেন— যদি তোমরা অনুমতি দাও তাহলে আবুল আসকে বিনা মুক্তিপণে মুক্তি দিতে চাই, সাহাবাগণ সন্তুষ্ট চিত্তে অনুমতি দিলে, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবুল আসকে মুক্তি দিয়ে দিলেন।
  6. হুনাইনের যুদ্ধে ৬ হাজার লোক মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের সবাইকে শুধু বিনা মুক্তিপণেই মুক্তি দেন নি বরং তাদের প্রত্যেককে একটি করে মিশরীয় চাদরও উপহার হিসেবে দিলেন। আজ সমগ্র বিশ্বে যারা নিজেদের বড়ত্ব, সভ্যতা ও মানবতাবাদের দাবী করে বেড়াচ্ছে, তারা তাদের শতবছরের ইতিহাসে এধরণের কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পেলে তা পেশ করুক!
  7. গামেদী বংশের এক মহিলা রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল— ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে পবিত্র করুন, সাথে সাথে একথাও স্বীকার করল যে আমি অবৈধভাবে গর্ভধারণ করেছি, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন— তুমি ফিরে চলে যাও, সন্তান প্রসবের পর আসবে, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার শাস্তি এজন্য দেরী করলেন, যেন নির্দোষ শিশু সন্তানটির ক্ষতি না হয়, সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর ঐ মহিলা আবার আসলে তিনি বললেন— যাও এখন গিয়ে তাকে দুধ পান করাও, দুধ পানের বয়স শেষ হলে আসবে, মহিলাটি আবার ফিরে চলে গেল, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বিতীয় বার তার শাস্তি এজন্য দেরী করলেন যেন একটি মা’সুম বাচ্চা তার মায়ের দুধ পান এবং স্নেহ বঞ্চিত না হয়। দুধপানের বয়স শেষ হওয়ার পর মহিলা আবার আসল, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার উপর শাস্তি কার্যকর করলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুধু মায়ের পেটেই সন্তানের নিরাপত্তার প্রতি গুরুত্ব দেন নি বরং সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পরও তাকে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করা পছন্দ করেন নি।
  8. ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এর শাসনামলে ইসলামী সেনাদল এক যিম্মীর (ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম প্রজার) জমির ফসল বিনষ্ট করে দিল, ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তখন বাইতুল মাল থেকে জমির মালিককে দশ হাজার দিরহাম ক্ষতিপূরণ দিলেন।[৪]

বাস্তবতা হল এই যে, ইসলাম আজ থেকে ১৪ শত বছর আগে যেভাবে মানবাধিকারকে সংরক্ষণ করেছে, পাশ্চাত্য তার সমস্ত উন্নতি, অগ্রগতি ও মুক্তচিন্তার অধিকার থাকা সত্বেও এধরণের মানবাধিকারের কল্পনাও করতে পারবে না।

জাতি সঙ্ঘের জেনারেল এসেম্বলীতে ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৮ খৃষ্টাব্দে মানবাধিকার সম্পর্কে ৩০ দফা সম্বলিত যে ঘোষণা পেশ করা হয়, তা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করলে দেখা যাবে যে এখানে মানবাধিকারের শুধু রেফারেন্সই রয়েছে, কিন্তু ইসলাম যেভাবে মানব জীবনের সকল স্তরে পৃথক পৃথক অধিকার নির্ধারণ করেছে, যেমন— পিতা-মাতার অধিকার, সন্তানদের অধিকার, স্বামীর অধিকার, স্ত্রীর অধিকার, প্রতিবেশীর অধিকার, এতীমের অধিকার, মিসকীন ও অভাবীদের অধিকার, ভিক্ষুকের অধিকার, মুসাফিরের অধিকার, বন্দীর অধিকার, ক্রীতদাসের অধিকার, অমুসলিমের অধিকার, এমনকি কিছুক্ষণের জন্য কারো নিকট অবস্থানকারীর অধিকার, পাশ্চাত্যের এধরণের অধিকার প্রতিষ্ঠার চিন্তা কিয়ামত পর্যন্ত আসবে না।

পাশ্চাত্যবাসীদের নিকট নারী অধিকারের যথেষ্ট বলিষ্ট কণ্ঠ শোনা যায়, কিন্তু সত্য কথা হল এই যে, পাশ্চাত্যবাসীরা নারী অধিকারের নামে নারীকে শুধু উলঙ্গই করেছে, এছাড়া আর কোন অধিকার যদি তারা নারীকে দিয়ে থাকে, তাহলে তাদের তা পরিষ্কার করা উচিত, অথচ ইসলাম নারীকে শুধু সম্ভ্রম এবং সম্মানই রক্ষা করে নি বরং তাকে সমাজে একজন সম্মানীতা এবং মানানসই স্থানও দিয়েছে, মা হিসেবে তাকে পিতার চেয়েও অধিক ভাল আচরণ পাওয়ার অধিকার দিয়েছে, স্ত্রী হিসেবে তার জন্য আলাদা অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে, মেয়ে এবং বোন হিসেবেও তাকে তার অধিকার দেওয়া হয়েছে, যদি বিধবা হয় তাহলে সে ক্ষেত্রেও তার অধিকার দেয়া হয়েছে, যদি ত্বালাক প্রাপ্তা হয়, তাহলে ঐ ক্ষেত্রেও তার অধিকার তাকে দেয়া হয়েছে। উন্নতী ও অগ্রগতি সম্পন্ন এবং মুক্তচিন্তার পাতাকাবাহী পাশ্চাত্য সমাজ আদৌ কি নারীকে এ অধিকার দিতে প্রস্তুত আছে? কিন্তু পাশ্চাত্যবাসীদের চক্রান্তের কি ধারণা যে, মায়ের পেটে শিশুর জীবনের নিরাপত্তা বিধানকারী ইসলামের নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সন্ত্রাসী, রক্তপাতকারী, হত্যাকারী নবী ছিলেন? (নাউজুবিল্লাহ্)।

আর শুধু একটি রাষ্ট্র ইরাকের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে ৫ লক্ষ মা’সুম বাচ্চাকে মৃত্যু মুখে পতিত কারী অ্যামেরিকা এবং পাশ্চাত্যবাসীরা সবচেয়ে বড় মানবাধিকার রক্ষা কারী?

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. অ্যামেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ মোহাম্মদ আলী কলী তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় লিখেছে যে, আমি ১৯৬০ খৃষ্টাব্দে ইটালীর রাজধানী রোমে একটি প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হয়ে অ্যামেরিকায় ফিরে আসলে, আমাকে একজন হিরুর ন্যায় অভ্যর্থনা দেয়া হল, একদিন হঠাৎ করে আমি এক হোটেলে চলে গেলাম যা মূলত শ্বেতাঙ্গদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। যখনই আমি একটি টেবিলে বসেছি, তখনই হোটেলের ম্যানেজার এক মহিলা অত্যন্ত রুক্ষ্মভাবে আমাকে বলল, “হোটেল থেকে বের হয়ে যাও, এখানে কোন কৃষ্ণাঙ্গের প্রবেশাধিকার নেই।” আমি বললাম, আমি রোমে অনুষ্ঠিত অলম্পিক প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হয়ে স্বর্ণের মেডেল লাভ করেছি। কিন্তু ঐ মহিলা কোন কথাই শোনলো না বরং জোরপূর্বক আমাকে হোটেল থেকে বের করে দিল। (আবদুল গনী ফারুক লিখিত, আমি কেন মুসলমান হলাম পৃঃ ৪৫৬)।
  2. উল্লেখিত পরিসংখ্যান সমূহ খালেদ মাহমুদ লিখিত গ্রন্থ “আফগানিস্তান মে মুসলমানু কা কতলে আম” নামক গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
  3. হাফতারোজী তাকভীর, করাচী, ৪ জানুয়ারি ২০০৬।
  4. মঈনুদ্দীন নদভী লিখিত তারিখ ইসলামী, পৃ ২২৩।