» » চার : খবরটা কতখানি গুরুতর

বর্ণাকার

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

দূরবীন

চার : খবরটা কতখানি গুরুতর

খবরটা কতখানি গুরুতর তা বুঝতে খানিক সময় নিল ধ্রুব। ফ্যালফ্যাল করে জগার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, মরে গেছে?

না। তবে অবস্থা খুব খারাপ।

কতটা খারাপ?

আমি অত জানি না। তবে বাবু ফিরে এলে তাঁর কাছে গিয়ে শুনে আসতে পারো।

তুমি আসল খবরটা লুকোচ্ছো না তো!

আরে না। তেমন খারাপ খবর হলে কি আর বাসা এত চুপচাপ থাকত?

রেমির বাপের বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে?

হ্যাঁ, তারা সব নার্সিং হোম-এ আছে।

আমারও কি একবার যাওয়া দরকার?

জগা বলে, গেলে বোধ হয় ভালই করতে। তবে তোমার যা অবস্থা দেখছি তাতে গিয়ে আবার একটা কেলেংকারী বাঁধাবে। তার চেয়ে রাতটা কাটিয়ে দাও। সকালে যেয়ো।

ততক্ষণ যদি রেমি না বাঁচে?

আমরা তো খবর নিচ্ছিই। লতু টেলিফোনের সামনেই বসে আছে। তাছাড়া গেলেও দেখা করতে তো আর পারবে না। দেখা করা একদম বারণ করে দিয়েছে ডাক্তার।

ধ্রুব একটা চেয়ারে বসে পড়ে।

খুবই চিন্তিতভাবে দু হাত জড়ো করে তাতে থুঁতনির ভর রেখে কিছুক্ষণ শূন্য চোখে চেয়ে থাকে সামনের দিকে। তারপর বলে, তুমি আজ রাতটা আমার ঘরে শোবে জগাদা?

কেন?

শোও না, খবরটা শোনার পর থেকে গাটা কেমন ছমছম করছে।

জগা অবাক হয়ে বলে, কিসের ছমছম?

রেমি আমাকে পছন্দ করে না, জানোই তো। যদি আজ রাতে রেমি মরে যায় তবে ঠিক ওর ভূত আমার গলা টিপতে আসবে।

জগা কানে আঙুল দিয়ে বলে, ছিঃ ছিঃ, এ কী কথা তোমার মুখে! অমন অলুক্ষণে কথা বলতে আছে?

ধ্রুব বলে, তুমি জানো না তাই বলছ। ও যে আমাকে কী ভীষণ ঘেন্না করে।

তা বলে জ্যান্ত মানুষটাকে ভূত বানাবে?

তুমি শোবে কিনা বলো।

শোবোখন। কিন্তু তোমরা লেখাপড়া শিখে কী হলে বলো তো!

ধ্রুব বিবর্ণ মুখে একটু কাঠ-কাঠ হাসি হেসে বলে, বই-পড়া বিদ্যে জীবনে কোনো কাজে লাগে না। এ তো জানোই জগাদা। থিওরেটিক্যালি আমি ভূতে বা ভগবানে বিশ্বাস করি না, কিন্তু ইন প্র্যাকটিস অন্য ব্যাপার।

তাই তো দেখছি। রাতে কিছু খাবে তো? নাকি খেয়ে এসেছো?

খাওয়া? ও বাবা খাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না।

রাতে তো প্রায় দিনই খাচ্ছো না। কাজটা ঠিক হচ্ছে না। শুকিয়ে যাবে।

ধ্রুব ঠ্যাং ছড়িয়ে বলে, তুমি বরং আলমারিটা খুলে দেখ। একটা ব্র্যাণ্ডির বোতল আছে। চার আঙুলের মতো ঢেলে দাও।

জগা চোখ গোল করে বলে, আরো খাবে?

নইলে ঘুম আসবে না। অমনিতেই আজ নেশা জমেনি, একটা হুজ্জোত বেঁধে গিয়েছিল। তারপর রেমির এই খবর।

হুজ্জোত বাঁধালে কেন? জগা ভ্রূ কুঁচকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলে।

ধ্রুব মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বলে, সে অনেক ব্যাপার।

বাবুর নাম তুমিই ডোবাবে।

ধ্রুব মুখের একটা বিকৃতি ঘটিয়ে বলে, কেন, সেটা বাবা নিজে পারে না?

তার মানে?

যা সব করে বেড়াচ্ছে তাতে নিজের নাম নিজেই ডোবাবে। ছেলের দরকার হবে না।

জগা অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলে, আজ কী হয়েছিল?

কালুর দোকানে একটু গণ্ডগোল, তেমন কিছু নয়।

কতটা গণ্ডগোল?

বললাম তো। বেশী নয়।

দেখ কুট্টি, আমার কাছে লুকিও না।

ধ্রুব হঠাৎ উঠে তার ট্রাউজারস ছাড়তে ছাড়তে বলে, পায়জামাটা কোথায় দেখ তো। শোবো। মাথা ঘুরছে।

জগা কথাটার জবাব দেয় না। তবে একধরনের বিপজ্জনক জ্বলজ্বলে চোখে ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলে, যা কিছু করে বেড়াচ্ছো তা বাপের খুঁটির জোরেই। না হলে এতদিনে কয়েকবার জেল খেটে আসতে হত, তা জানো?

ধ্রুব ছাড়া প্যান্টটা একটা লাথি মেরে উড়িয়ে দেয়। সেটা গিয়ে দরজার কাছে পড়ে। গায়ের আঁটো পুলওভারটা খুলতে গিয়ে বগলের কাছ বরাবর আটকে গেল। জগার দিকে ঘুরে সে বলে, একটু টেনে খুলে দাও তো।

জগা একটা প্রকাণ্ড হাত বাড়িয়ে একটা হ্যাঁচকা টান মেরে সোয়েটারটা খুলে আনে। সোয়েটারটা খুলে আসে বটে, কিন্তু হ্যাঁচকা টানে টাল খেয়ে অবলম্বনহীন ধ্রুব দুটো হাত ওপর দিকে তুলে অসহায়ভাবে পড়ে একটা কাতর শব্দ করে। জগা হাত বাড়িয়ে তাকে আর একটা হ্যাঁচকা টানে তুলে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলে, বাপের নাম বংশের নাম ডোবাতে এ বাড়ির ছেলে হয়ে তোমার লজ্জা করে না, কিন্তু আমরা চাকর হয়েও তোমার কাণ্ড দেখে লজ্জা পাই।

ধ্রুব একটু হাঁফাচ্ছিল। মাথাটা দু হাতে চেপে ধরে বলল, ওঃ। এত কথা বলো কেন? একটু ব্র্যাণ্ডি দাও, নেশাটা পুরো না হলে আমার মাথাধরাটা ছাড়বে না।

চাবিটা দাও।

কিসের চাবি?

লোহার আলমারির। তাইতেই তো ব্র্যাণ্ডি আছে বললে।

ওঃ সেই চাবি। ওই চেস্ট অফ ড্রয়ার্সের ওপরের ড্রয়ারটা দেখ।

জগা গিয়ে ড্রয়ার খুলে চাবিটা বের করে নেয়। তারপর ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলে, আমি যাচ্ছি। খেয়ে আবার আসব। ততক্ষণ চুপচাপ বসে থাকো।

ধ্রুব তাড়াতাড়ি ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। জগা দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। বাইরে থেকে দরজাটা টেনে দেয় সাবধানে।

ধ্রুব আতঙ্কিত চোখে দরজাটার দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অবোধ দৃষ্টি। তারপর ফাঁকা ঘরটার চারদিকে চায়। হঠাৎ খুব শীত করতে থাকে তার। নাভির কাছ থেকে একটা কাঁপুনি উঠে আসছে। সে গিয়ে কাঠের ওয়ার্ডরোব খুলে একটা ধোয়া পায়জামা বের করে খুব কষ্টে পরে নেয়। গায়ে একটা আলোয়ান জড়ায়। তারপর দরজা খুলে বেরোয়। আস্তে আস্তে দোতলার সিঁড়ি ভেঙে উঠতে থাকে। নেশাটা খুব একটা টের পাচ্ছে না এখন।

তার বাবার লাইব্রেরি ঘরটা জিনিসে ঠাসা। চারদিকে লম্বা লম্বা বইয়ের আলমারি। মস্ত বড় ডেস্ক আর রিভলভিং চেয়ার। একটা ডিভান এবং তার সামনে একটা টুল। বসবার জন্য আরো গোটা চারেক গদি আঁটা চেয়ার রয়েছে। কয়েকটা টেবিলে রয়েছে বাঁকুড়ার ঘোড়া থেকে শুরু করে হরেক রকমের শিল্পকর্মের নিদর্শন। কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসও রয়েছে। রিভলভিং চেয়ারটায় বসে লতু একটা বই পড়ছে। তার বয়স কুড়ির মধ্যে। চোখে চশমা, অত্যন্ত ফর্সা রং, মুখশ্রীও সুন্দর। তবে মুখচোখ তার সবসময়েই ভীষণ সিরিয়াস এবং বিরক্তিতে ভরা। সে যে হাসে খুবই কম তা তার মুখের দিকে একবার তাকালেই বোঝা যায়। বোঝা যায়, এই পৃথিবী বা এই মানবীজন্ম সে একটুও পছন্দ করছে না।

ধ্রুব ঘরে ঢুকতেই লতু চোখ তুলে চাইল।

ধ্রুব তার বোন লতুকে যে ভয় পায় তা নয়, কিন্তু এর সামনে সে একটু অস্বস্তি বোধ করে। মেয়েটা যেন কেমনতরো। তাছাড়া রেমির সঙ্গে লতুরই ভাব কিছুটা গাঢ়।

ধ্রুব শীতে কাঁপছিল। সেই কাঁপুনি তার গলাতেও প্রকাশ পেল, কিছু খবর আছে নাকি রে লতু?

লতুর গলা খুবই নির্বিকার। বলে, অবস্থা ভাল নয়।

কী হয়েছে? আজ বিকেলেও তো নরমাল ছিল।

হেমারেজ। অপারেশন করা হতে পারে।

আমি একটু বসব এখানে?

বোসো। বলে লতু দাদার দিকে একটু যেন তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতেই তাকায়, কখন ফিরেছে?

একটু আগে। বলে ধ্রুব টেবিলের ওপর টেলিফোনটার দিকে ইশারা করে বলে, কতক্ষণ আগে লাস্ট খবরটা এসেছে?

আধ ঘণ্টা।

কে ফোন করেছিল?

বাবা।

কী বলল?

ওই তো যা বললাম। তুমি গিয়ে শুয়ে থাকো না। আমরা খবর নিচ্ছি।

কেন, আমি এখানে বসে থাকলে কি তোর অসুবিধে হবে?

না, তা হবে কেন?

তবে? ফোনটা আমাকে দে, আমি একটু কথা বলব।

লতু টেলিফোনটা ঠেলে এগিয়ে দিয়ে বলে, বলতে পারো, তবে লাভ নেই। বাবা ওখানে আছেন। খবর কিছু থাকলে উনিই টেলিফোন করবেন বলেছেন।

ধ্রুব তবু টেলিফোনটা তুলে নেয়। লতুর দিকে চেয়ে বলে, নারসিং হোমের নমবরটা বল তো।

লতু জবাব দেয় না, একটা প্যাড এগিয়ে দেয়। তাতে লাল পেনসিলে নমবরটা লেখা।

ডায়াল করতে করতেই ধ্রুব টের পায়, সে কোনো খবর জানতে চায় না। রেমির জন্য চিন্তা করার অনেক লোক আছে। রেমিকে নিয়ে যে উদ্বেগ ও ব্যস্ততা চলছে তার মধ্যে নিজেকে ভেড়াতেও সে চাইছে না। সে চাইছে এই সময়টা একা ঘরে বসে ভয়ংকর সব চিন্তার আক্রমণ থেকে কিছুক্ষণ দূরে সরে থাকতে।

একটা মোটা গলা নারসিং হোমের নামটা উচ্চারণ করল ওপাশ থেকে।

ধ্রুব খুব দায়িত্বশীল এবং উদ্বিগ্ন স্বামীর মতোই বলল, রেমি চৌধুরির কনডিশন কেমন? কেবিন নমবর ফাইভ।

একটু ধরুন।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর তাকে চমকে দিয়ে ভারী গলাটা বলে, হ্যালো।

বলুন।

কনডিশন একই রকম।

অপারেশন হবে?

হ্যাঁ। ওটিতে নিয়ে যাওয়া হবে কিছুক্ষণ বাদে।

খুব চিন্তার কিছু আছে কি?

ডাক্তাররা বলতে পারেন। আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

ডাক্তার মজুমদারকে একটু দিতে পারেন টেলিফোনে?

উনি এখন ভীষণ বিজি।

আচ্ছা শুনুন, রেমি চৌধুরির একটা বাচ্চা হয়েছিল আজ বিকেলে। সেই বাচ্চাটা কেমন আছে?

বাচ্চা ভাল আছে।

আর ইউ সিওর?

হ্যাঁ।

থ্যাংক ইউ।

এতক্ষণ লতু একবারও দাদার দিকে তাকায়নি। বই পড়ছিল। এবার তাকিয়ে একটা হাই তুলে আবার বইয়ে মুখ গুঁজল।

ধ্রুবর একটু লজ্জা করছিল। রেমির জন্য যে তার কোনো উদ্বেগ আছে তা বোধ হয় লতু এখনো বিশ্বাস করে না। আর বসে থাকার মানে হয় না। ধ্রুব উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে দোতলার বারান্দাটায় দাঁড়ায়। দোতলায় গোটা সাতেক ঘর আছে। লাইব্রেরি ছাড়া আরো চার-পাঁচটা ঘরে আলো আছে। বাইরে থেকে বাড়িটাকে যতটা ঘুমন্ত পুরী মনে হয়েছিল ততটা নয়।

কিন্তু এখন ওইসব ঘরের কোনোটাতেই গিয়ে দুদণ্ড বসবার বা সময় কাটাবার উপায় নেই।

বোমা মেরে মাঝে মাঝে এই বাড়িটাকে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে তার। সেটা পারছে না বলেই অন্যভাবে সে প্রতিশোধ তুলে নিচ্ছে।

তাতে কাজ হচ্ছে কি? বনেদী বাড়ি এবং ভি আই পি বাবার ভিত একটুও নড়াতে পেরেছে কি সে? ঠিক বুঝতে পারছে না।

ধ্রুব আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে নীচে। আসার পথে দু-একজন চাকর-বাকর শ্রেণীর লোকের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায় তার। প্রত্যেকের মুখেই একটা উদ্বেগ ও গাম্ভীর্য লক্ষ করে সে। তবে তার সঙ্গে কেউই কথা বলে না বা অভিবাদনও করে না কোনোরকম। এ বাড়ির সবাই বুঝে গেছে, ধ্রুব ফালতু লোক।

নিজের ঘরের ভেজানো দরজাটার সামনে এসে ধ্রুব দাঁড়ায়। ঘরে ঢুকতে কেমন অস্বস্তি আর ভয়-ভয় করছে তার। আশ্চর্যের বিষয়, ভয়টা ভৌতিক। কিন্তু সেরকম ভয়ের কোনো কারণ ঘটেনি। রেমি এখনো মরেনি এবং হয়তো মরবেও না। তাহলে ভয়টা কিসের?

ধ্রুব খুব ভাল ব্যাখ্যা করতে পারছিল না ব্যাপারটা। শরীরের অবস্থা পরিষ্কার চিন্তা করার মতো নয়। আধখ্যাঁচড়া নেশা করার ফলেই বোধ হয় ভয়টা থাবা গেড়ে আছে মাথায়। নেশা না করলে বা পুরো নেশা করলে এরকম হয়তো হত না। এক অদ্ভুত শীতে তার শরীর এখনো থরথর করে কাঁপছে, সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।

দেয়ালে শরীরের ভর রেখে সে কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইল। চোখ বুজতেই দেখতে পেল রেমির মুখ। নারসিং হোমের বালিশে আধো-ডুবন্ত সেই মুখ শীর্ণ, সাদা এবং তৎসত্ত্বেও সুন্দর। চোখ বোজা, চোখের পাতায় একটা হালকা নীল ছোপ পড়েছে। ঠোঁট শুকনো। দৃশ্যটা দেখে শিহরিত হয় ধ্রুব। চোখ খোলে।

প্যাসেজ ধরে একটা লোক আসছে। বগলে গোটানো বিছানা। চাকর। এ বাড়িতে চাকর অনেক। পুরোনোদের চেনে ধ্রুব। কিন্তু আজকাল অনেক নতুন রিক্রুট হয়েছে, তাদের নামও ধ্রুব জানে না। এই লোকটাও তাদের দলে। বয়স বেশী নয় ছোকরার। ধ্রুবকে দেখে উল্টোদিকের দেয়াল ঘেঁষে সভয়ে চলে যাচ্ছিল।

ধ্রুব ডাকল, এই শোনো।

ছেলেটা দাঁড়িয়ে যায়।

জগাদা কোথায় বলো তো?

খাওয়ার ঘরে।

যাও তো, গিয়ে বলল আমি তাড়াতাড়ি আসতে বলেছি।

উনি তো হাসপাতালে যাবেন।

সে কী? হাসপাতালে কেন?

বউদির জন্য?

কেন?

বলছিলেন যদি রক্ত দিতে হয় তাই যাবেন।

ধ্রুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। জগাদা নারসিং হোমে যাচ্ছে, তার মানে কত রাতে ফিরবে বা আদৌ ফিরবে কিনা তার ঠিক নেই। কিন্তু একা ঘরে তার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। ধ্রুবর মাথায় চকিতে একটা বুদ্ধি খেলে যায়। সে ছোকরাটাকে বলে, তুমি কোথায় শুতে যাচ্ছো?

আজ্ঞে ওই পিছন দিককার সিঁড়ির নিচে।

আজ ওখানে শুতে হবে না। তুমি বরং আজ আমার ঘরে শুয়ে পড়ো।

ছেলেটা অবাক হয়। বলে, কিন্তু বাবা আমাকে ওখানেই শুতে বলেছেন।

বাবা! তোমার বাবা কে?

আজ্ঞে শ্রীজগবন্ধ রায়। যাকে আপনি জগাদা বললেন।

জগাদার ছেলে তুমি?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

ধ্রুব হঠাৎ একটু চটে গিয়ে বলে, জগাদার ছেলে হয়ে তুমি এ বাড়িতে সকরের কাজ করতে ঢুকেছো কেন? আর কাজ পেলে না?

ছেলেটা একটু হকচকিয়ে গিয়ে বলে, আমি আর এক জায়গাতেও কাজ করি।

কোথায়?

বাবার কোমপানিতে। বেয়ারা।

কী পাশ করেছে?

হায়ার সেকেণ্ডারি।

কোন ডিভিশন পেয়েছিলে?

সেকেণ্ড ডিভিশন।

আর পড়োনি কেন?

পড়ছি তো।

পড়ছ? ধ্রুব অবাক হয়। কী পড়ছো?

নাইট কলেজে বি কম ক্লাসে ভর্তি হয়েছি।

এ বাড়িতে কী কাজ করতে হয়?

এই ফাইফরমাস।

সম্মানে লাগে না?

ছেলেটা মুশকিলে পড়ে গিয়ে বলে, কিছু অসুবিধে হয় না।

তুমি যে বি কম পড়ছ তা বাড়ির মালিক জানে?

জানে।

তা সত্ত্বেও ফাইফরমাস করে?

ছেলেটা এবার একটু হেসে বলে, বাবাও তো এ বাড়িতে কাজটাজ করে। তাই আমিও করি।

আর অফিসে যে বেয়ারার চাকরি করো সেটা কেমন লাগে করতে?

খারাপ লাগে না। খাটুনি তো বেশী নয়। আমি পড়ার বই নিয়ে যাই, অফিসে বসে পড়ি।

ধ্রুবর একটু ক্লান্তি লাগে।

জগাদার এই ছেলেটিকে সে কখনো দেখেনি। ছেলেটা জীবনের মোড় ফেরানোর জন্য জানপ্রাণ দিয়ে লড়ছে। নিজের শ্ৰেণীকে ছাড়িয়ে উচ্চতর শ্রেণীতে প্রবেশের ছাড়পত্র একদিন পেয়ে যাবেই। কিন্তু এত পরিশ্রম এরা করে কী ক’রে? দিনে বেয়ারা, সকালে বিকেলে বাড়ির চাকর আর রাত্রে কলেজের পড়ুয়া। আরেব্বাস!

ধ্রুব একটু হেসে বলল, তুমি আজ আমার ঘরেই শোও। আমি জগাদাকে বলে দিচ্ছি। আমার শরীরটা আজ ভাল নেই, ঘরে একজন লোক থাকা দরকার।

ছেলেটা এ কথায় মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল।

ধ্রুব দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। পিছনে ছেলেটি, সসঙ্কোচে।

ওই কোণের দিকে বিছানাটা পেতে নাও। মশারি আছে?

আছে।

আমি জগাদাকে বলে দিয়ে আসছি।

ছেলেটা বিছানাটা কাঠের আলমারির সামনে নামিয়ে রেখে বলল, আপনাকে যেতে হবে না, আমিই বাবাকে বলে আসছি। বাবা বলেছিলেন, দরকার হলে আমাকেও রক্ত দিতে যেতে হবে। দরকারের সময় যদি আমাকে খুঁজে না পান তাহলে রেগে যাবেন।

ধ্রুব বিছানায় বসে নিজের কপাল চেপে ধরল। মাথা নেড়ে অস্ফুট গলায় বলল, আচ্ছা।

ছেলেটা যাওয়ার সময় সাবধানে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে গেল।

ধ্রুব নিজের হাতঘড়িটা দেখল। বারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট। এতক্ষণে কি রেমিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে? বোধ হয়। না, রেমির জন্য তার কিছু করার নেই। তাকে কেউ কিছু করতে বলছে না। এমন কি রক্ত দেওয়ার জন্য বাড়ির কাজের লোকদের প্রস্তুত রাখা হচ্ছে, তাকে নয়। তার রক্ত বোধ হয় অশুচি।

খুবই দুঃখ হতে লাগল ধ্রুবর। আসলে নেশাটা আধখ্যাঁচড়া হলেই তার দুঃখ-টুঃখ উথলে ওঠে। সে ভেবে দেখল, রেমির জন্যই শুধু নয়, পৃথিবীর কারো জন্যই তার কিছু করার নেই।

একটা মশা ডান পায়ের গোড়ালিতে কামড়াল। বসে বসে একটু ঢুলুনি এসেছিল ধ্রুবর, মশার কামড়ে চমকে উঠল। না, ছেলেটা এখনো আসেনি। বিছানাটা তেমনি গোটানো অবস্থায় পড়ে আছে।

এ বাড়িতে আগে মশা ছিল না। আজকাল হয়েছে। কিন্তু ধ্রুব নিজের মশারিটা টাঙানোর কথা ভাবল না। প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট আর দেশলাই বের করে টেবিলে রেখেছিল। প্যাকেটটা তুলে নিয়ে একটা সিগারেট ধরায় সে। ঘুম আসবে না। বড় শীত করছে।

দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে না? ধ্রুব স্থির হয়ে গেল। খুব জোরে রেলগাড়ি দৌড়তে লাগল বুকের মধ্যে।

হ্যাঁ, দরজাটা খুলে যাচ্ছে একটু একটু করে। কোনো দরজাই এত রহস্যময়ভাবে খোলা উচিত নয়। কোনো অশরীরী, কোনো অচিন বাতাস কি খুলছে দরজা?

কে, বলে বিকট একটা চিৎকার করে ওঠে ধ্রুব।

দরজাটার ফাঁক হওয়াটা থেমে যায়। মৃদু মোলায়েম একটা মিয়াঁও আওয়াজ ক্ষীণ এসে পৌঁছোয় ধ্রুবর কানে।

আশ্চর্য! সাদা আর বাদামীতে মেশানো সেই কাবলে বেড়ালটা না? রেমির বেড়াল। এটাকে কোনোকালে দু চক্ষে দেখতে পারে না ধ্রুব, কী চায় বেড়ালটা? এ ঘরে তো কখনো আসে না!

ধ্রুব বিস্ফারিত চোখে চেয়ে ছিল। মনের মধ্যে অনেক উল্টোপাল্টা যুক্তিহীন কার্যকারণ কাজ করে যাচ্ছে। রেমির বেড়াল কখনো এঘরে আসে না, কিন্তু আজ এল কেন? এর মানে কি, কোনো অশুভ ইঙ্গিত? নাকি বেড়ালটি মৃতপ্রায় রেমির প্রতিনিধি হয়ে কিছু বলতে এসেছে তাকে?

বেড়ালটা নির্নিমেষ চোখে চেয়ে ছিল ধ্রুবর দিকে। মৃদু আর একটা মিয়াঁও আওয়াজ করল সে।

আতঙ্কিত ধ্রুব কিছুতেই বেড়ালটার চোখ থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিল বেড়ালটা তাকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। খুব ধীরে ধীরে তার বাহ্যচেতনা লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

অসহায় ধ্রুব বিকারগ্রস্তের মতো ডাকল, জগাদা! জগাদা!

দরজাটা হাট করে খুলে গেল হঠাৎ। জগার বিশাল চেহারাটা দাঁড়াল দরজা জুড়ে।

কী ব্যাপার! এখনো শোওনি?

ধ্রুব বেড়ালটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওটা এখানে কেন? কী চায়?

জগা বেড়ালটাকে দেখে নীচু হয়ে কোলে তুলে নিয়ে একটু আদর করে বলল, আহা, বউমা নেই বলে ভারী একা হয়ে পড়েছে বেচারা। ঘুরে ঘুরে খুঁজছে।

ধ্রুব একটা বড় শ্বাস ফেলল। ভয়টা বেরিয়ে গেল শ্বাসের সঙ্গে। বলল, তোমার ছেলেকে এখানে শুতে বলেছি।

হ্যাঁ, বলছিল আমাকে। কিন্তু শোওয়ার কি কারো সময় হবে আজ? বউমার অপারেশন শুরু হল বলে। বাবু ফোন করেছিল, রক্ত দিতে পারে এমন কয়জন লোক চাই।

ধ্রুব হঠাৎ নড়েচড়ে বসে বলল, সে তো আমিও দিতে পারি।

জগা হাসল, সে তো ভাল কথা। বউমার জন্য যদি কিছু করতে পারো তাহলে বুঝবো মরদ। কিন্তু যা মাল টেনে বসে আছে এ অবস্থায় ডাক্তাররা কি তোমার রক্ত নিতে চাইবে?

তবু আমি সঙ্গে যাবো।

তুমি খুব ভয় খেয়েছে কুট্টি। কিসের এত ভয় তোমার?

জানি না। তবে ভয় খাচ্ছি ঠিকই, জগাদা চাবি দাও। আর খানিকটা না খেলে আমি মরে যাবো।

জগা ট্যাঁক থেকে চাবিটা বের করে ধ্রুবর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, কুট্টি, তোমার সব সাহস বিপ্লব আর তেজ গিয়ে এখন বোতলে জমা হয়েছে। এটা কিন্তু খুব কেরদানির কথা নয়। যাও, গিলে পড়ে থাকো। মা বাপ বউ বা দুনিয়ার জন্য কিছু তোমাকে ভাবতে হবে না। কিছু ভাল লোক দুনিয়াকে চালিয়ে নেয়, আর তোমার মতো কিছু ফালতু লোক বসে বসে খায় আর ফুর্তি করে।

তুমি আমাকে ঘেন্না করো জগাদা?

না, কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি, ঘেন্না করতে চাইলেই বা পারব কেন?

আমি তোমাদের সঙ্গে যাবো। তার আগে একটু মেরে নিই দাঁড়াও।