ইসলাম সাধারণ মানুষের জন্য যেমন শান্তি ও নিরাপত্তার দ্বীন, এমনিভাবে সমগ্র সমাজের জন্যও একটি শান্তি ও নিরাপত্তার দ্বীন। আল্লাহ্ যেমন সাধারণ মানুষের হেদায়েতের জন্য কোরআন মাজীদে কিছু কিছু বিধান অবতীর্ণ করেছেন এমনিভাবে সামাজিক নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য কিছু কিছু অপরাধের শাস্তির বিধানও রেখেছেন, যে বিধানগুলো ঐ রকম অপরিবর্তনীয়— যেমন নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্বের বিধানগুলো অপরিবর্তনীয়। আল্লাহ্‌র নির্ধারণকৃত শাস্তি যাকে ইসলামের পরিভাষায় “হুদূদ”(দণ্ডবিধি) বলা হয় তা নিন্মরূপ—

  1. চুরীর শাস্তি— চোরের শাস্তি হল তার হাত কেটে দেয়া। (৫ : ৩৮)।
  2. ডাকাতির শাস্তি— সশস্ত্র ডাকাতদল যদি ডাকাতি করার সময় কাউকে হত্যা করে কিন্তু সম্পদ লুট না-করে তাহলে তার শাস্তি হল হত্যার বিনিময়ে হত্যা।
    আর ডাকাতি করার সময় যদি হত্যা করে এবং সম্পদও লুট করে, তাহলে তার শাস্তি শূলিতে চড়ানো, আর ডাকাতি করার সময় যদি শুধু সম্পদ লুট করে হত্যা না করে তাহলে তার শাস্তি হল তাদের হস্ত ও পদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কাটা। (৫ : ৩৩)।
  3. সত্বী-সাধ্বী নারীদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয়ার শাস্তি— সতী-সাধ্বী নারীদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয়ার শাস্তি ৮০টি বেত্রাঘাত।(২৪ : ৪)।
  4. অবিবাহিত নর-নারীর যিনার (ব্যভিচারের) শাস্তি— একশত বেত্রাঘাত ।(২৪ : ২)। যদি নর ও নারী উভয়ের সম্মতিতে যিনা (ব্যভিচার) হয়ে থাকে, তাহলে উভয়েরই উক্ত শাস্তি হবে, আর যদি কোন একজনের ইচ্ছায় জোরপূর্বক যিনা (ব্যভিচার) হয়ে থাকে, তাহলে যে জোর করে যিনা (ব্যভিচার) করেছে তার এ শাস্তি হবে।
  5. বিবাহিত নর-নারীর যিনার (ব্যভিচার) শাস্তি— তাদেরকে পাথর মেরে হত্যা করা। (বোখারী ও মুসলিম)। উল্লেখ্য, বিবাহিত নর-নারীর যিনার (ব্যভিচারের) শাস্তি পাথর মেরে হত্যা করা, এসংক্রান্ত আয়াতটি কোরআ’ন মাজীদের সূরা আহযাবে অবতীর্ণ হয়েছিল, কিন্ত পরবর্তীতে আল্লাহ্ তা’য়ালা ঐ আয়াতের বিধান কার্যকর রেখে তার তেলওয়াত রহিত করে দেন, এ বিধানের উপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমল করেছেন, তাঁর মৃতুর পর খোলাফায়ে রাশেদীনগণ আমল করেছেন। (আশরাফুল হাওয়াসী, ফুটনোট নং—৯ পৃঃ ৪১৮)।
  6. মদ পানের শাস্তি— নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগে এবং আবুবকর সিদ্দীক (রাযিয়াল্লাহু আনহুর) যুগে মদ পানের শাস্তি ছিল ৪০টি বেত্রাঘাত, ওমর ফারুক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর শাসনামলে সাহাবাগণের পরামর্শ ক্রমে মদপানের শাস্তি নির্ধারণ করেন ৮০টি বেত্রাঘাত, এব্যাপারে আবদুর রহমান বিন আউফ (রাযিয়াল্লাহু আনহুর) পরমার্শ ছিল দণ্ডবিধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম শাস্তি হল মিথ্যা অপবাদের শাস্তি, তাই মদ পানের শাস্তিও কম পক্ষে তার সমপর্যায়ের হওয়া উচিত। তাই মদ পানের শাস্তি তখন ৮০টি বেত্রাঘাত নির্ধারণ করা হল, এব্যাপারে সমস্ত সাহাবাগণের ঐক্যমত ছিল এবং এর উপর আমলও শুরু হল।

আমাদের এটা দৃঢ় বিশ্বাস যে আল্লাহ্‌র নির্ধারণ কৃত শাস্তির বিধানে আল্লাহ্‌র দৃষ্টিতে মানুষের প্রতি দয়ারই বহিঃপ্রকাশ, আর এ শাস্তির বিধান বাস্তবায়ন করার মধ্যে আদম সন্তানের জন্য কল্যাণ রয়েছে, আর তা বাস্তবায়ন ব্যতীত কোন সমাজ ব্যবস্থাতেই মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়।

নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং সাহাবাগণের যুগে ইসলামের বিজয়ের মাধ্যমে যে সমস্ত এলাকাগুলো ইসলামী সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, সেখানে যখন ইসলামী আইন কার্যকর করা হল, তখন ঐসমস্ত এলাকাসমূহে শান্তি ও নিরাপত্তার দৃষ্টান্ত স্থাপন হল।

নজদের শাসক আদী বিন হাতেম নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে দ্বিধা সংকোচ করছিল, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন— আদী হয়ত তুমি মুসলমানদের স্বল্পতা এবং কাফেরদের আধিক্য দেখে ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিরত আছ, আল্লাহ্‌র কসম! অতিশীঘ্রই সমগ্র আরবে ইসলামের পতাকা বিজয়ী দেখতে পাবে, আর শান্তি ও নিরাপত্তার এমন এক দৃষ্টান্ত কায়েম হবে যে, একজন মহিলা একা একা যানবাহনে আরোহণ করে কাদেসিয়া (ইরানের একটি শহর) থেকে রওয়ানা হয়ে নির্ভয়ে সফর করে মদীনায় পৌঁছে যাবে, সফরকালে তার মধ্যে শুধু আল্লাহ্‌র ভয় থাকবে। একথা শুনে আদী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ইসলাম গ্রহণ করল এবং নিজের মৃত্যুর পূর্বে একথার সাক্ষ্য দিলেন যে, আল্লাহ্‌র কসম! রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণী সত্যে পরিণত হয়েছে, আমি স্বচোখে দেখেছি যে একজন মহিলা একা একা নিজের যানবাহনে আরোহণ করে কাদেসিয়া থেকে নির্ভয়ে সফর করে মদীনায় পৌঁছেছে। বিশাল আয়তন বিশিষ্ট ইসলামী সম্রাজ্যে জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা একমাত্র ইসলামী দণ্ডবিধি কার্যকর থাকার কারণেই সম্ভব হয়েছে।

আজকের এই অশান্তির যুগে পৃথিবীর সভ্য এবং উন্নত দেশসমূহে দৃষ্টি দিয়ে দেখুন যে যদি পৃথিবীর কোথাও এমন কোন দেশ থাকে যেখানে দিন ও রাতের যেকোন সময় মানুষ নির্ভয়ে সফর করতে পারবে তাহলে সেটা সৌদী আরব, যেখানে না শোয়ার কোন ভয় আছে না জীবনের না ইজ্জতের। নিরাপত্তা ও শান্তির এ পরিবেশ ইসলামী দণ্ডবিধি কার্যকর করার কারণে যদি না হয় তাহলে আর কি কারণে?

মরোক্কোতে নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত ওলফ্রেড হুফ মীন ইসলাম গ্রহণ করার পর ইসলামী দণ্ডবিধি সম্পর্কে একটি গ্রন্থ রচনা করে, যেখানে সে চোরের হাত কাটা, হত্যার বিনিময়ে হত্যাকারীকে হত্যা করা, যিনা (ব্যভিচারকারীকে) পাথর মেরে হত্যা করা সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোচনা করেছে, সেখানে সে একথা প্রমাণ করেছে যে মানবতাকে শান্তি ও নিরাপত্তা দেয়ার জন্য এদণ্ডবিধি কায়েম করা ব্যতীত আর কোন উপায় নেই।[১]

প্রিয় জন্মভূমিতে (লেখকের) যখন থেকে আধুনিক ইসলামের ধারক এবং আলোকিত চিন্তার সরকার এলো তখন থেকেই ইসলামী বিধানাবলী এবং ইসলামী নিদর্শনসমূহের প্রতি ঠাট্টার ধারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে চালু হল, আর তখন নুতন করে ইসলামী দণ্ডবিধি আইনে কিছু বিশেষ নযরধারী শুরু হয়, ফলে খোলাখুলিভাবে পরিষ্কার ভাষায় ইসলামী দণ্ডবিধিকে হিংস্র এবং জুলুম বলে আখ্যায়িত করা হল, যার পরিষ্কার অর্থ দাঁড়ায় এ শাস্তির বিধান প্রবর্তনকারী সত্বা (আল্লাহ্ মাফ করুন, আবারো আল্লাহ্ মাফ করুন) হিংস্র এবং জালেম।

চিন্তা করুন

  • যে মহান সত্বা তাঁর নিজের জন্য দয়ালু, করুনাময়, ক্ষমাশীল এধরণের গুণাবলী বেছে নিয়েছেন তিনি কি হিংস্র এবং জালেম হতে পারেন?
  • ঐ সত্বা যিনি সর্বধা স্বীয় বান্দাদের গোনাহ্ মাফ করে তাদেরকে স্বীয় নে’মত দান করে থাকেন, তিনি কি হিংস্র ও জালেম হতে পারেন?
  • ঐ সত্বা যিনি তাঁর আরশে একথা লিখে রেখেছেন যে, আমার রহমত আমার রাগের উপর বিজয়ী (বোখারী ও মুসলিম) তিনি কি হিংস্র এবং জালেম হতে পারেন?
  • ঐ সত্বা যিনি তার রহমতের ৯৯ ভাগ কিয়ামতের দিন তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করার জন্য রেখে দিয়েছেন (বোখারী ও মুসলিম) তিনি কি জালেম হতে পারেন?
  • ঐ সত্বা যার সমস্ত ফায়সালা বিজ্ঞানময়, যার সমস্ত ফায়সালা সর্বপ্রকার ত্রুটিমুক্ত, যার সমস্ত ফায়সালা প্রশংসার দাবী রাখে, তিনি কি তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে হিংস্র এবং অবিচার করতে পারেন?
  • ঐ সত্বা যিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি জুলুম না-করার ওয়াদা করেছেন (৫০:২৯) তিনি কি তাঁর বান্দাদের প্রতি হিংস্র এবং জুলম মূলক ফায়সালা করতে পারেন?
  • অতএব হে আমার জাতির নেতা, সরকারের সর্বোচ্চ মসনদে বসে আল্লাহ্ তা’য়ালাকে গালি দিবে না। দয়াময়, অনুগ্রহশীল, অত্যন্ত ধৈর্যশীল, মহাজ্ঞানী সত্বার শ্রেষ্টত্ব এবং তাঁর মর্যাদার ব্যাপারে বেয়াদবী করা থেকে বিরত থাক। তাঁর শাস্তি ও পাকড়াওকে ভয় কর, স্বীয় গোনাহের জন্য তাঁর নিকট তাওবা কর।
  • যাতে এমন না হয় যে এ সর্বোচ্চ মসনদ থেকে ছিটকে পড়।
  • যেন এমন না হয় যে, আকাশ থেকে পাথর বৃষ্টি বর্ষিত হতে শুরু করে।
  • যেন এমন না হয় যে, আকাশ থেকে ফেরেশ্তাগণকে অবতরণ করার হুকুম দেওয়া হয়।
  • এমন যেন না হয় যে পৃথিবীর নীচের অংশ উপর এবং উপরের অংশ নীচে করে দেওয়া হয়।
  • এমন যেন না হয় যে আকাশ ও যমিনের মুখগহ্বর উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে আর এ উভয়ের পানি মিলিত হয়ে সবকিছুকে একাকার করে দিবে।
  • এমন যেন না হয় যে, চরম ক্ষুধা এবং করুণ অভাব ও লাঞ্ছনা আর অপমান আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।
  • এমন যেন না হয় যে ভূমি ধ্বস, ভূমিকম্প, চেহারার বিকৃতি, পাথর বৃষ্টি আমাদের উপর বর্ষণ না হয়।

এর পর আমরা আশ্রয় খুঁজব অথচ কোথাও আশ্রয় পাব না, তাওবা করতে চাইব হয়ত তাওবা করার সুযোগ পাব না, অতএব হে জাতির প্রধান! কোরআনের এ হুশিয়ারী বাণী কান খুলে শোন—

أَأَمِنْتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يَخْسِفَ بِكُمُ الْأَرْضَ فَإِذَا هِيَ تَمُورُ ١٦ أَمْ أَمِنْتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يُرْسِلَ عَلَيْكُمْ حَاصِبًا ۖ فَسَتَعْلَمُونَ كَيْفَ نَذِيرِ ١٧ وَلَقَدْ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَكَيْفَ كَانَ نَكِيرِ ١٨

অর্থ— “তোমরা কি ভাবনা মুক্ত হয়ে গেছ যে, আকাশে যিনি আছেন তিনি তোমাদেরকে ভূগর্ভে বিলীন করে দেবেন, অতঃপর তা কাঁপতে থাকবে, না তোমরা নিশ্চিত হয়ে গেছ যে, আকাশে যিনি আছেন তিনি তোমাদের উপর প্রস্তর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, অতঃপর তোমরা জানতে পারবে কেমন ছিল আমার সতর্ক বাণী। তাদের পূর্ববর্তীরা মিথ্যারোপ করেছিল, অতঃপর কত কঠোর হয়েছিল আমার অস্বীকৃতি। (সূরা মুলক-১৬-১৮)

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. রোজনামা জঙ্গ, লাহোর।