৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫।
রেঙ্গুনে দুই ঘণ্টা থামতে হবে। পিআইএ-র দৌড় ওই পর্যন্তই। এরপর বিওএসি-তে যেতে হবে ব্যাঙ্কক। ব্যাঙ্কক-যাত্রীরা বেশির ভাগই বেরিয়ে পড়ল ভোরের রেঙ্গুন দেখতে। একা রানা বসে থাকল প্যাসেঞ্জারস লাউঞ্জে। ঢাকা এয়ারপোর্টে কেনা আজকের বাংলা কাগজটা খুলল ও। এতক্ষণ প্লেনে ওটা ভাঁজ করে নিয়ে বসেছিল, খুলতে সাহস হয়নি, পাছে কেউ চিনে ফেলে।
খবরের কাগজে পরিষ্কার উঠেছে ছবিটা প্রথম পৃষ্ঠায়। ভাঙাচোরা জাগুয়ার গাড়িটার দুমড়ানো দরজা দিয়ে বেরিয়ে আছে রানার দেহের অর্ধাংশ। রক্তে (লাল কালিতে) ভেসে গেছে কপাল, গাল, জামার একাংশ। কিন্তু চেনা যাচ্ছে ওকে পরিষ্কার। হেডিং-সড়ক দুর্ঘটনায় এক ব্যক্তির মৃত্যু। নীচে লেখা:
(নিজস্ব সংবাদদাতা)
গতকল্য বৃহস্পতিবার বৈকাল সাড়ে ছয়টায় চন্দ্রার নিকট, গাছের সহিত ধাক্কা খাইয়া একটি জাগুয়ার গাড়ি, ই বি এ ৪৭৮৪, সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হইয়া চালক ঘটনাস্থলেই নিহত হইয়াছেন। বেপরোয়া গতিতে গাড়িটি ঢাকা হইতে আসিতেছিল। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ হইতে জানা যায়, পথের উপর খেলায় রত দুইটি বালককে রক্ষা করতে গিয়া ডান দিকে কাটিয়া একটি গাছের সহিত ধাক্কা খাইয়া গাড়িটি চুরমার হইয়া যায়। নিহত চালক জনাব মাসুদ রানা ঢাকার ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। ময়না তদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হইয়াছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রানা ভাবল সত্যিই যদি ওর মৃত্যু ঘটত তা হলেও ঠিক এমনি নিরুত্তাপ ভাষায় লাইন ক’টি লেখা হত। তারপর ভুলে যেত সবাই ওর কথা। নতুন নতুন মানুষ আসত এই পৃথিবীতে—ঢেউয়ের পর ঢেউ আসত নতুন জেনারেশন—হাজার হাজার বছর পার হয়ে যেত। এখনকার মতই চাঁদ উঠত আকাশে পৃথিবীটাকে স্নিগ্ধ আলোয় মায়াময় করে দিয়ে, সাগর দুলত আবেগে, মাতাল হাওয়া এসে নিবিড় করে তুলত প্রেমিক-প্রেমিকার মধু-মিলন। তরুণ তার প্রথম প্রেমের রঙে রাঙিয়ে নিত এই ভুবন; যৌবনের গর্বে বুক ফুলিয়ে বলত, ‘আমি ভালবাসি, ভালবাসি এই সুন্দর পৃথিবীকে।’ তারপর একদিন সে-ও হারিয়ে যেত রানারই মত কালের অতলে। মানুষের জীবনটা কী! কী এর উদ্দেশ্য?
মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নিয়ে এসব বাজে চিন্তা দূর করে দিল মাসুদ রানা। যতক্ষণ বেঁচে আছে অন্তত ততক্ষণ তো ও স্বেচ্ছাধীন। তার ইচ্ছের ঘোড়া যেদিক খুশি ছোটাতে পারে—কাল মহাকালের থোড়াই পরোয়া করে সে! তারপর যা হবার হোক না, কে মানা করতে গেছে।
লাগাও ব্রেকফাস্ট। তারপর আবার প্লেন। পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে ব্যাঙ্কক।
ব্যাঙ্ককে কাস্টমস চেকিং হয়ে যেতেই বেরিয়ে এল রানা। মৃদু হেসে ভাবল, ওর অ্যাটাচী কেসটা দেখলেই হয়েছিল কাজ। পঞ্চাশটা একশো ডলারের কড়কড়ে নোট ছিল একটা চোরা পকেটে। কাউকে না জানিয়ে এগুলো এনেছে ও হোম ডেলিভারী স্কিমে এক বন্ধুর জন্যে কিছু শখের জিনিস কিনে পাঠাবে বলে।
‘মিস্টার মাসুদ রানা?’ গগলস আঁটা এক ভদ্রমহিলা কাছে এসে দাঁড়াল। বয়স ছাব্বিশ সাতাশ হবে। গায়ের রঙ রীতিমত ফর্সা। চমৎকার স্বাস্থ্য। বোধহয় অ্যাংলো-থাই হবে। নাক-মুখের চেহারা অপূর্ব বলা যাবে না। মঙ্গোলিয়ান টাইপ। কিন্তু চমৎকার একপাটি ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসল মেয়েটি।
‘ইয়েস।’
‘দিস ইজ ক্যাথি ডেভন। গ্ল্যাড টু মিট ইয়ু।’
‘গ্ল্যাড টু মিট ইয়ু,’ উত্তর দিল রানা।
আপনার জন্যে গাড়ি তৈরি। আসুন আমার সঙ্গে। ব্রিস্টল হোটেলে আপনার জন্য রুম রিজার্ভ করা আছে। মি. ক্রিয়াং শ্রীসানান জরুরী কাজে সায়গন গেছেন। আমার ওপর অভ্যর্থনার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। আশা করি প্লেনে সময়টা ভালই কেটেছে।’
‘নাহ। খুব খারাপ! পাহাড়গুলোর ওপর দিয়ে আসবার সময় এত বাম্প করেছে যে মাথাটা ঘুরছে এখনও। ভাবছি পায়ে হেঁটে দেশে ফিরব।’
‘আপনার দুর্ভাগ্য। আজ বোধহয় আবহাওয়া কিছু গোলমাল করেছে। সাধারণত এমন অনুযোগ শোনা যায় না।’
স্যাণ্ড বিজ কালারের ছোট্ট একটা এইট-ফিফটি ফিয়াট দাঁড়িয়ে ছিল, ড্রাইভিং সিটে বসে ভেতর থেকে ওপাশের দরজাটা খুলে দিল ক্যাথি ডেভন। ছোটখাটো টু-ডোর গাড়িটা বেশ পছন্দ হলো রানার। উঠে বসল প্যাসেঞ্জার সিটে। গাড়ির ওই সিটটাকে ডেথ সিট বলে—কোন এক আমেরিকান ম্যাগাজিনে পড়েছিল। অ্যাক্সিডেন্টে ওই সিটের যাত্রীই বেশি আহত হয়। মুচকি একটু হাসল রানা।
পাকা হাত মেয়েটির। যখন ডান দিকে মোড় ঘুরবে তখন ঠিক ডানদিকেই সিগনাল দিচ্ছে; আমাদের দেশি মেয়ে ড্রাইভারের মত বাঁয়ে সিগনাল দিয়ে ডাইনে ঘুরছে না। কাজেই নিশ্চিন্ত মনে এদিক ওদিক চাইতে চাইতে চলল রানা। পিচ ঢালা রাস্তা দিয়ে বেশ কয়েক মাইল গিয়ে শহরে ঢুকল গাড়ি। একেবারে বাংলাদেশের মত দেশটা। কিন্তু আমাদের চেয়ে অনেক দ্রুত এখানকার জীবন যাত্রা। শহরের মধ্য দিয়ে গেছে অসংখ্য খাল—তাই অসংখ্য কালভার্ট। প্রচুর আমেরিকান মুখ দেখা গেল। সহজ সাবলীল ভঙ্গিতে এটা ওটা চেনাতে চেনাতে এগিয়ে চলল ক্যাথি ডেভন। চারতলা ব্রিস্টল হোটেল। তিনতলায় রানার ঘর।
‘বিকেলে আমাদের মেকাপম্যান এসে আপনার চেহারা পাল্টে দিয়ে ফটো তুলে নিয়ে যাবে। মি. ক্রিয়াং শ্রীসানান সব ব্যবস্থা করে গেছেন। কাল আপনার নতুন পাসপোর্ট পেয়ে যাবেন দশটার ভেতর। আপনি আপনার ঘরে বিশ্রাম নিন। টেলিফোন আছে, যা লাগবে রুম-সার্ভিসে বলে দেবেন, সোজা আপনার ঘরে চলে আসবে।’
‘দুপুরের লাঞ্চটা কোথায় সারা যায় বলুন তো? আসুন না, এক সঙ্গেই লাঞ্চ করা যাক?’ রানা বলল।
‘ঠিক আছে। আমি ক’টা কাজ সেরেই চলে আসছি ঘণ্টা খানেকের মধ্যে।’
ক্যাথি ডেভন বেরিয়ে যেতেই রানা স্নান সেরে নিল। ইজি চেয়ারে শুয়ে, সিগারেট ধরাল একটা। এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে আবার বাংলা কাগজটা খুলল। চুরি, নৃশংস ভাবে স্ত্রী-পুত্র হত্যা, মোহামেডান স্পোর্টিং এর ৩-০ গোলে জয়লাভ, ভিয়েৎকং সৈন্যদের গুলিতে তিনটি মার্কিন বিমান ভূপাতিত, প্রেসিডেন্টের পিণ্ডি প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি শেষ করে বিজ্ঞাপনগুলোর উপর কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে আর একবার নিজের মৃত্যুসংবাদটা পড়ল। হাসি পেল ওর।
এনামুল হক নিশ্চয়ই এতক্ষণে ইদু মিয়ার কাছ থেকে খবর পেয়ে টয়োটা করোনার কাজ শুরু করে দিয়েছে। রাহাত খান মোটা হাভানা চুরুট ধরিয়ে কাজে মগ্ন। রেহানা রানার অবর্তমানে রানার সহকর্মী জাহেদ ইকবালের ডিকটেশন লিখছে শর্ট হ্যাণ্ডে। জেল পলাতক কবীর চৌধুরীর মনটা খারাপ হয়ে যাবে নিজ হাতে রানাকে শেষ করতে পারল না বলে। চিটাগাং-এর আবদুল হাই, কুষ্টিয়ার সোহেল এরা চমকে উঠবে। ভাববে আহা–ব্যাটা নেহাত খারাপ লোক ছিল না। জয়দ্রথ মৈত্র ঠোঁটের কোণের ঘা চেটে নিয়ে হাসবে তার বীভৎস হাসি। আর মিত্রা? দুঃখ পাবে? খুশি হবে?
মিত্রার মনের অবস্থাটা ঠিক কল্পনা করতে পারল না রানা। ওর জটিল মনের মধ্যে রানার জন্যে কতখানি দুর্বলতা আছে তা জানা সম্ভব হয়নি রানার পক্ষে। দেশ-প্রেম ওর কাছে অনেক বড়। হিন্দুসমাজ সংস্কারের প্রতি আছে গভীর অনুরক্তি, অথচ ভালবেসেছে এক বিদেশী মুসলমানকে। রানার মৃত্যু সংবাদে হয়ত মিত্রা হাঁফ ছেড়ে বেঁচে যাবে। সেই রাত্রির ঘটনাটিকে সাময়িক দুর্বলতা বলে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করবে। নিজের দেশ, নিজ আত্মীয়স্বজন, সমাজ, এতদিনকার মজ্জাগত সংস্কার, সব ভাগ করে নতুন জীবনে ঝাঁপ দেয়ার দ্বন্দ্ব থেকে তো সে অন্তত মুক্তি পেল।
কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে রানা ভাবল মানুষের কাজ না থাকলে বোধহয় এসব বেহুদা চিন্তা মাথার মধ্যে কিলবিল করে। ও এসব কী ভাবছে? জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে রইল ও আনমনে।
‘ব্যাক গিয়ারটা কোন দিকে?’ ড্রাইভিং সিটের নীচে লিভারটা ডান দিকে চাপ দিয়ে সিটটা কয়েক ইঞ্চি পিছিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘অন্যান্য গিয়ার জানেন তো? ব্যাক হচ্ছে চেপে নিচু করে ফোর্থ গিয়ার।’
সাঁ করে বেরিয়ে গেল রানা হোটেল থেকে ক্যাথি ডেভনকে নিয়ে।
লাঞ্চের আগে আমি একটু বাসা হয়ে যেতে চাই। বাড়ির কাউকে বলা হয়নি, ওরা অপেক্ষা করবে। দুমিনিট লাগবে আমার। লজ্জা পেল ক্যাথি একটু।
‘তাতে কী—চলুন না। আপনি শুধু ডাইনে-বাঁয়ে বলে দেবেন। বাড়িতে টেলিফোন নেই বুঝি?’
‘না, এখন আর নেই। এখন আমরা খুব গরিব হয়ে গেছি।’
‘গাড়িটা আপনার না?’
‘আমার হবে কেন? অফিসের। আমার হলে তো এক্ষুণি বেচে দিতাম।’
‘কেন?’
চট করে অন্য কথায় চলে গেল ক্যাথি। রানা বুঝল এসব ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি। পাঁচ মিনিট পর একটা সরু গলির ভিতর ঢুকল গাড়িটা। একটা পুরনো ইট বের করা, প্লাস্টার খসে পড়া বাড়ির সামনে থামল গাড়ি। রাস্তার পাশে কলে জল নেবার জন্য লাইন লেগে গেছে। বালতি-হাতে একটা ছোট্ট অর্ধ-উলঙ্গ মেয়েকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল ক্যাথি, ‘বাবা কী করছে রে? মেজাজ কী রকম?’
‘এই রকম!’ চোখ-মুখ পাকিয়ে একটা ভঙ্গি করে খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটি। তারপর অবাক হয়ে রানাকে লক্ষ্য করতে আরম্ভ করল।
‘আমার বোন,’ বলল ক্যাথি রানাকে। আপনি গাড়িতেই বসুন এই ইলেকট্রোফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে, আমি এক্ষুণি আসছি।’
‘আপনার বাবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবেন না?’
একটু ইতস্তত করল ক্যাথি, তারপর ডাকল রানাকে।
নোংরা ঘর। মেঝেটা খাওয়া খাওয়া। খুবই সস্তা দরের কয়েকটা কাঠের চেয়ার, তাও আবার কোনোটার হাতল ভাঙা, কোনোটার পা মচকানো। একটা ময়লা পর্দা ঝুলছে দরজায়।
হঠাৎ সেই দরজা দিয়ে একটা ইনভ্যালিড চেয়ারে বসে এক হাতে চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে একজন বৃদ্ধ এসে ঢুকল ঘরে। ক্যাথি পরিচয় করিয়ে দিল বাবার সঙ্গে। এক ফোঁটা হাসি নেই বৃদ্ধের মুখে। গম্ভীর মুখে তীক্ষ্ণ দুটো সন্দেহপূর্ণ চোখ মেলে আপাদমস্তক লক্ষ্য করল বৃদ্ধ রানাকে। রানার পরিচয় যে সে একবিন্দু বিশ্বাস করল না তা স্পষ্ট বোঝা গেল। অস্বস্তি লাগছে রানার। ক্যাথি বলল, ‘আমরা দুপুরে বাইরে খাচ্ছি আজ, তাই বলতে এলাম।’
হঠাৎ বৃদ্ধ পরিষ্কার ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল ক্যাথিকে, ‘এতক্ষণ এই লোকটার সঙ্গে ছিলে তুমি? একে চেনো না তুমি, যে বিয়ে করতে যাচ্ছ?’
চমকে উঠল রানা। ফ্যাকাসে হয়ে গেল ক্যাথি ডেভনের মুখ। শুধু বলল, ‘বাবা!’
‘ন্যাকামি কোরো না। ভেবেছ আমি কিচ্ছু টের পাই না? শয়তান মেয়ে! বিয়ের জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে! বাপ-মা-ভাই-বোন কিছু না? দূর হ তুই আমার বাড়ি থেকে। তোর টাকা না খেলেও চলবে আমার।‘ এবার রানার দিকে অগ্নিদৃষ্টি ফেলল বৃদ্ধ, ‘আর তুমি, হারামজাদা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছ? জামাই হতে এসেছ? মনে করেছ কোলে বসিয়ে দুই গালে চুমু দেব সকাল-বিকেল? জানো, তোমাকে পুলিশে দেব আমি! বদমাইশ, সর্বনাশ করতে এসেছ আমাদের?’
দুই হাতে চোখ ঢেকে কেঁদে ফেলল ক্যাথি। এমন সময় একজন প্রৌঢ়া থাই ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকল। রানা এবং ক্যাথির দিকে এক নজর চেয়েই ব্যাপারটা আঁচ করে নিয়ে বলল, ‘অ্যাই, আবার তুমি বাইরের ঘরে এসেছ?’ ইনভ্যালিড চেয়ারটা ঠেলে পাশের ঘরে নিতে নিতে রানার দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি দয়া করে কিছু মনে করবেন না, মি. …’
রানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনল বুড়ো চিৎকার করে বলছে, ‘সবাই জোচ্চোর, সব শয়তান! আমি এদের চিনি না মনে করেছ? এখন আমাদের কী অবস্থা হবে? বিয়ে করলে আর টাকা দেবে ক্যাথি?’—গলাটা ভেঙে গেল। কাঁদতে আরম্ভ করল বৃদ্ধ।
‘এত বড় সংসার নিয়ে এবার পানিতে পড়লাম রে…’
মহিলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘চুপ করো! আহ চুপ করো তো, লক্ষ্মী। ক্যাথি বিয়ে করছে কে বললে তোমাকে? ছি ছি, ওই ভদ্রলোকের সামনে তুমি মেয়েটাকে কতবড় অপমান করলে বলো তো।’
‘ভদ্দোরনোক! উহ! পরিষ্কার ডাকাতের চেহারা। উনি আবার ভদ্দেরনোক সাজতে এসেছেন…’
রুমালে চোখ মুছে নিয়ে ক্যাথি বলল, ‘মাফ করবেন, মি. রানা। আপনি গাড়িতে গিয়ে বসুন, আমি মাকে বলেই চলে আসছি।’
হতবাক রানা গাড়িতে গিয়ে বসল। ঠিক দু’মিনিটেই চলে এল ক্যাথি। গাড়ি ছাড়ল রানা।
লাবন্ লুয়াং রোডের রেইনবো হোটেলে ইংলিশ লাঞ্চ অর্ডার দিল ও। সুপের মধ্যে গোল মরিচের গুঁড়ো ফেলতে ফেলতে রানা বলল, ‘আপনার বাবার এই অবস্থা কতদিন ধরে?’
‘কী অবস্থা?’
‘এই, মানে একটু অপ্রকৃতিস্থতা…’
‘আমার বাবা পাগল নন। উনি ভুগছেন সন্দেহ রোগে। আর এই রোগও আরম্ভ হয়েছে অল্পদিন ধরে। পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে পড়ায় ওঁর মস্ত ব্যবসা বন্ধু বান্ধব, পার্টনার আর কর্মচারীরা মিলে উচ্ছন্নে দিয়েছে। অনেক টাকা ধার হয়ে গেল বাজারে। সেই থেকে সবাইকে সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছেন উনি। আমি এবং আমার এক বোন উপার্জন করে সংসার না চালালে সবাই না খেয়ে মারা যাবে। তাই ওঁর সন্দেহ আমরা নিজের সুখের জন্যে স্বার্থপরের মত বিয়ে করে ফেলব। এবং সংসারে টাকা আসা বন্ধ হয়ে যাবে। সব সময় এই অবস্থা থাকে না। প্রত্যেক মাসের প্রথমে যখন টাকা তুলে দিই বাবার হাতে, বাবা তখন ছেলে মানুষের মত হাউ মাউ করে কাঁদে। বলে—তোদের আমি নিংড়ে শুষে ছোবড়া বানিয়ে ফেলছি রে, ক্যাথি। দোহাই তোদের, আমাকে একটু বিষ এনে দে। আমি মরলেই তোরা সুখে সংসার বাঁধতে পারবি।’ হঠাৎ সচকিত হয়ে ক্যাথি বলল, ‘ছি ছি, আপনাকে এসব কী বলছি!’
‘আমার কিন্তু শুনতে বেশ লাগছে। আপনার বাবা কি এদেশের…’
‘উনি আয়াল্যাণ্ডের। আমার মায়ের প্রেমে পড়ে বিয়ে করে এখানেই সেটল করেছিলেন। তাই আমরা হয়েছি এক মিশ্র জাত। ধর্ম আমাদের ক্রিশ্চানিটি। সমাজে স্থান নেই। সবাই ‘অ্যাংলো’ বলে মুখ বাঁকায়।
‘আপনার বোনও কি চাকরি করেন?’
‘না, সে নৃত্য-শিল্পী। ঠিক শিল্পী বলা যায় না। নেচে টাকা উপার্জন করে আর কী। কলকাতার গ্র্যাণ্ড হোটেলে আছে ও এখন। নেচে যা পায় খরচটা রেখে দিয়ে সব পাঠিয়ে দেয় বাবার কাছে। আমাদের বোধহয় প্রসঙ্গ পরিবর্তন করা উচিত। এসব দুঃখের কথা, আপনি শুনে কী করবেন?’
পুডিং শেষ হতেই কফি এল। একটা সিগারেট নিজে নিয়ে প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিল রানা ক্যাথির দিকে। দুটো সিগারেটে আগুন ধরিয়ে রানা বলল, আপনার ভবিষ্যৎ জীবনের প্ল্যান কী?
‘ভবিষ্যতের চিন্তা একদম বন্ধ করে দিয়েছি।’
‘কেন?’
‘আমরা যে পাঁকে পড়েছি, এ থেকে বেরোতে আরও দশ বছর লাগবে। আমার বয়স কত জানেন? দেখলে অনেক কম মনে হয়, আসলে বত্রিশ। দশ বছর পর হবে বেয়াল্লিশ। তারপরেও কি আর কোনও ভবিষ্যৎ থাকতে পারে মেয়েমানুষের? প্ল্যান করে লাভ আছে কোনও? আমার জন্যে অনন্তকাল তো আর অপেক্ষা করতে পারবে না উইলিয়াম।’
‘দশ বছর কেন?’
‘আমরা দু’বোন সমস্ত সংসার খরচের পর গড়পড়তা এক শ’ ডলার (থাই বাহত-এর হিসাব দেশি পাঠকদের বুঝতে অসুবিধে হতে পারে বলে ডলারেই লেখা হচ্ছে টাকা-পয়সার কথা। Baht 25=Dollar 1=Rs.5.00; মোটামুটি এই হিসেব মনে রাখলেই চলবে।) করে জমাচ্ছি প্রতিমাসে। আড়াই বছরে তিন হাজার ডলার জমিয়েছি আমরা। যখন আরও বারো হাজার জমাতে পারব তখন আমাদের সব ঋণ শোধ হয়ে যাবে। এই রাস্তার ওপরেই আমাদের একটা ছয়তলা বাড়ি আছে। সেটা মর্টগেজ মুক্ত হয়ে যাবে। সে বাড়ির ভাড়াই মাসে এক হাজার ডলার—আবার বড়লোক হয়ে যাব আমরা। কিন্তু তখন আমাদের আর বয়স থাকবে না সেটা উপভোগ করবার।’ ম্লান হাসি ফুটে উঠল ক্যাথির পাতলা ঠোঁটে।
‘আচ্ছা, এতবড় দায়িত্বের বোঝা ইচ্ছে করলেই তো কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিজে সুখী হতে পারেন আপনি। কেন আপনি নিজের জীবনটা…’
‘ওকথা বলবেন না।’ দুই হাতে কান ঢাকল ক্যাথি। ‘ওকথা শোনাও পাপ। অনেকে বলেছে, এমনকী উইলিয়ামও। ভুলেও যদি করে বসি একাজ—তা হলে তার প্রায়শ্চিত্ত হবে আত্মহত্যা।’
‘কোনও আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে ধার পাওয়া সম্ভব নয়?’
‘না। সে চেষ্টা করেছি।’
‘তবে তো দেখছি আপনার সুখের সব দরজা বন্ধ।’
‘হোটেলের দরজা তো আর বন্ধ নয়। বেলা অনেক হয়েছে। চলুন, আপাতত ওই দরজা দিয়ে বেরোনো যাক।’ হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল ক্যাথি। রানার মনে পড়ল ঠিক এমনি করেই হাসে ক্যাথির দশ বছরের অর্ধ-উলঙ্গ দুষ্টু বোনটা। ‘এবং ধন্যবাদ। আপনাকে সব কথা বলে নিজেকে অনেক হাল্কা লাগছে এখন।’
বিকেলে মেকাপম্যান এসে আধঘণ্টা পরিশ্রম করল রানার মুখের উপর। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অন্য একটা লোককে দেখতে পেল রানা। মোটামুটি মঙ্গোলিয়ান চেহারা দাঁড়িয়েছে।
‘উঠিয়ে না ফেললে এই দাগ হপ্তাখানেক থাকবে। তারপর প্রয়োজন হলে আবার এক পোচ বুলিয়ে নেবেন। কেমিক্যালসের শিশি দুটো রেখে যাচ্ছি।’ উঠে দাঁড়াল লোকটা। তারপর রানার একটা ছবি তুলে নিল। এটা পাসপোর্টে যাবে। আপনার নাম চরোসা থিরা। থাই আয়রন অ্যাণ্ড স্টিল ইণ্ডাস্ট্রিজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর।’
লোকটা বেরিয়ে যেতেই এসে ঢুকল ক্যাথি ডেভন।
‘বাহু, চমৎকার হয়েছে। এখন তৈরি হয়ে নিয়ে চলুন দেখি, আপনার জন্যে সুটকেস, জামা-কাপড়, সবকিছু নতুন করে কিনতে হবে। আপনার এই থ্যাবড়া সুটকেস ফেরত যাবে পাকিস্তানে।’
কাপড়-চোপড়, জুতা-মোজা, টাই-টাইপিন, ইত্যাদি যাবতীয় জিনিসপত্র কিনে সন্ধ্যার সময় ফিরল ওরা হোটেলে। ক্যাথি চলে যাচ্ছিল কাল দেখা হবে বলে, ‘কিন্তু রানা ওকে যেতে দিল না।’
‘আজ সন্ধ্যেটা আমার সঙ্গে কাটাতে হবে, মিস ডেভন। কাল দশটার পর কোথায় আমি আর কোথায় আপনি। জীবনে আর দেখা হবে না। আমার অনুরোধটার অমর্যাদা করবেন না দয়া করে।’
অবাক দৃষ্টিতে রানার দিকে চাইল একবার ক্যাথি। নাহ্। কোনও খারাপ মতলব আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। কী ভেবে রাজি হয়ে গেল। মুখে বলল, ‘কিন্তু আটটার বেশি থাকতে পারব না। বাড়ির অবস্থা তো দেখেই এসেছেন।’
গাড়িতে উঠে রানা বলল, ‘এখানকার সবচেয়ে নাম করা, ক্যাসিনো কোনটা? সবচেয়ে উঁচু স্টেকে খেলা হয় যেখানে?’
ক্যাসিনো কথাটা বোধহয় বুঝল না ক্যাথি, কিন্তু উঁচু স্টেকে খেলার কথা শুনে বুঝল জুয়া খেলার কথা হচ্ছে। বলল, ‘ডায়মণ্ড হাউস।’
‘কোথায় সেটা?’
‘সুরায়য়াং রোডে। আমি ঢুকিনি কখনও ভেতরে। কেন?’
‘চলুন ডায়মণ্ড হাউসেই সন্ধ্যেটা কাটাই।’
বিরাট ক্যাসিনোর চকচকে মোজাইক করা মেঝে। এন্ট্রি ফি দিয়ে দোতলায় উঠে এল ওরা। চারদিকে নানান রকম খেলার ব্যবস্থা। সুন্দরী থাই মেয়েদের সঙ্গে জোড়া বেঁধে প্রচুর আমেরিকান বসে আছে। Chemin de fer এবং Caisse-র পাশ কাটিয়ে ওরা একটা কোণের খালি টেবিলে গিয়ে বসল। নিজের জন্যে একটা স্কচ এবং ক্যাথির জন্যে ভোদকা মাটিনি অর্ডার দিল রানা। একটা সিগারেট অর্ধেক বের করে ক্যাথির দিকে ধরল প্যাকেটটা, তারপর নিজে নিল একটা।
সিগারেট ধরিয়ে রানা বলল, ‘আমি একজন পাক্কা জুয়াড়ি। খুব খারাপ লোক, সন্দেহ নেই। কিন্তু আজ আমার খেলতে ভয় করছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি আজ আমার ভাগ্য সহায়তা করবে না। খেললে ঠিক হেরে যাব। আমাকে একটু সাহায্য করবেন আপনি?’
‘আমি জীবনে এসব খেলিনি। তা ছাড়া এসব পছন্দও করি না। চাকরি খোয়াবার ভয় না থাকলে কিছুতেই আপনার সঙ্গে এখানে ঢুকতাম না। এখন বলুন, কী সাহায্য করতে হবে?’ একটু বিরক্তি ক্যাথির কণ্ঠে।
‘খুব সোজা খেলা। আমার হয়ে আপনাকে একটু খেলতে হবে।’
‘বললাম তো, আমি এসব খেলা জানি না।’
‘আপনার কোনও চিন্তা নেই। শিখিয়ে দেব। আমি যা বলব আপনি শুধু তাই করবেন। এই নিন চার হাজার ডলার। রুলেত খেলতে হবে আপনাকে।’
বিস্মিত ক্যাথি বলল, ‘বাব্বা, এত টাকা! যদি হেরে যাই?’
‘ব্যাপারটা আগে আপনাকে বুঝিয়ে বলি।’ নোটগুলো ক্যাথি ডেভনের হাতে দিয়ে রানা বলল, ‘এই টাকা আপনাকে ধার দিচ্ছি, কারণ ধার না দিলে আমার আজ রাত্রির মন্দ ভাগ্যের আওতা থেকে রেহাই পাবে না টাকাগুলো। আমরা, পাকা জুয়াড়িরা, সৌভাগ্য এবং মন্দভাগ্যের অদৃশ্য হাত উপলব্ধি করতে পারি এক আশ্চর্য শক্তির বলে। এবং সেটার নির্দেশ মেনে চলি। যেই ধার দিয়ে দিলাম, অমনি এই মুহূর্ত থেকে ওই টাকা আমার না। বুঝেছেন? কিন্তু যাতে হেরে গেলে ওই ধার আপনাকে আবার শোধ করতে না হয় সেজন্যে টাকাটা কোথায় কীভাবে খেলতে হবে সেটা আমি আপনাকে বলে দেব। হারলে আমার দোষে হারবেন, আপনি দায়মুক্ত।’
‘কত প্যাঁচ! জুয়াড়িদের নানান কুসংস্কার থাকে জানতাম—কিন্তু আপনার মধ্যেও…’ হাসল ক্যাথি। ‘বেশ, এখন বলুন কী করতে হবে।’
রুলেত টেবিলের সামনে অল্প লোকের ভিড় ছিল। রানা জিজ্ঞেস করল, ‘এখানকার সবচেয়ে উঁচু স্টেক কত?’
‘আনলিমিটেড! যত খুশি খেলতে পারেন।’ নিরুৎসুক কণ্ঠে জবাব দিল কাঠিহাতে লোকটা।
‘মিস ডেভন, টাকাগুলো ক্রুপিয়া-র (Croupier) কাছে দিয়ে কালোয় খেলুন।’
‘সব একসঙ্গে?’ অবাক হয়ে যায় ক্যাথি।
‘হ্যাঁ, সব।’
চার হাজার ডলার দেখে শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল ক্রুপিয়া-র। চটপট গুণে নিয়ে আড়চোখে দেখে নিল একবার রানাকে। নোটগুলো টেবিলের ফাঁক দিয়ে ভিতরে ফেলে দিয়ে চল্লিশটা লাল ‘প্লেক’ নিয়ে কালো ঘরে রাখল। আরও কয়েকজন অল্প-স্বল্প স্টেক ধরল। টেবিলের তলায় হাত ঢোকাল একবার ক্রুপিয়া, রানা বুঝল, কোথাও একটা বেল বেজে উঠল নিশ্চয়ই। যেন হাওয়ায় ভেসে দু’জন ষণ্ডা মত লোক এসে দাঁড়াল টেবিলের পাশে। ঘুরিয়ে দেয়া হলো থালাটা। হাতির দাঁতের ছোট্ট সাদা বলটা ছুটে বেড়াতে লাগল থালাময়।
রানা চেয়ে দেখল ক্যাথি একদৃষ্টে চেয়ে আছে থেমে আসা থালাটার দিকে। কী করে জানি রানা জানত, জয় অনিবার্য। মৃদু হাসল ও।
‘থারটিন। ব্ল্যাক। লো অ্যাণ্ড অড।’ উঁচু গলায় বলল কাঠিধারী।
উজ্জ্বল হয়ে উঠল ক্যাথির চোখ। রানার দিকে চাইল সে। এক বস্তা লাল ‘প্লেক’ জমল ক্যাথির পাশে। মোট আশিটা হলো।
‘আবার চল্লিশটা দিন কালোয়।’
কাঠি দিয়ে ‘প্লেক’-গুলো গুণে নিয়ে কালোয় রাখা হলো। আবার থেমে এল থালাটা। আশপাশে লোক জড়ো হতে আরম্ভ করেছে। হাতির দাঁতের বলটা এঘর ওঘর টপকে গিয়ে একটা ঘরে থামল।
‘টোয়েনটি। ব্ল্যাক। হাই অ্যাণ্ড ইভেন।’
বাচ্চা মেয়ের মত আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল ক্যাথি ডেভন। অদ্ভুত এক অনাস্বাদিতপূর্ব উত্তেজনা অনুভব করছে সে। নেশায় পেয়ে বসেছে যেন ওকে। জিজ্ঞেস করল, ‘এবার?’
‘এই দানটা আমরা খেলব না,’ বলল রানা।
অবাক হয়ে ক্যাথি এবং ক্রুপিয়া চাইল রানার দিকে। মাথা নাড়ল রানা। রানার ভেতর থেকে কে যেন বলে দিল অপেক্ষা করো।
আশপাশে সবার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিল রানা। এতক্ষণ যারা দশ বিশ ডলার খেলছিল, রানার জেতা দেখে তারাও স্টেক বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ ত্রিশ, কেউবা পঞ্চাশ। জমে উঠেছে খেলা। লোকে ভিড় করতে আরম্ভ করল এই টেবিলে। আবার ঘুরল থালা।
থালা থামতেই রানা দেখল ছোট্ট বলটা পড়ল গিয়ে সবুজ দুটো ঘরের একটায়। বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল একবার। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি তো!
স্টিকধারী চিৎকার করে বলল, ‘ডাবল জিরো!’ তারপর কালো লাল সব। ঘরের প্লেকগুলোই তুলে নিল টেবিল থেকে।
‘এবার রেড,’ রানা হাসল ক্যাথির দিকে চেয়ে।
‘কত?’ ডাবল জিরো দেখে ভয় ধরে গেছে ক্যাথির। বুকের ভিতরটা ওর কেঁপে উঠল একবার রানা যখন বলল, ‘চল্লিশ।’
বেশ লোক জড়ো হয়ে গেছে এবার। কানাঘুষো হচ্ছে ওদেরকে নিয়ে। ক্যাথির হাত থেকে প্লেকগুলো নিয়ে লালে রাখল কাঠিধারী। আবার ঘুরল থালা। রানা টের পেল কিছু উৎসুক চোখ লক্ষ্য করছে ওর মুখ। নিরাসক্ত ভাবে সিগারেট ধরাল ও। একবিন্দু কাঁপল না হাত। কিন্তু ভিতর ভিতর একটু উত্তেজিত না হয়ে পারল না রানা। প্রতিবারই কি ভাগ্য তার সহায় হবে? এইবার খেলা কি উচিত হলো?
থালাটা যখন থেমে আসছে রানা দেখল কপালের ঘাম মুছছে ক্যাথি। হাত কাঁপছে তার। সেই মুহূর্তে আরেকবার রানা ঘৃণা করল জুয়া খেলাটাকে। এ এক কুৎসিত সংক্রামক ব্যাধি।
‘থারটি-ফোর। রেড। হাই অ্যাণ্ড ইভেন।’
মৃদু গুঞ্জন উঠল আশপাশে। লোভী দৃষ্টিতে সবাই চেয়ে দেখল গুণে গুণে আশিটা লাল ‘প্লেক’ ক্যাথির পাশে সাজিয়ে দিল ক্রুপিয়েই। মোট হলো একশ ষাটটা।
‘ব্যস। চলুন,’ রানা ডাকল ক্যাথিকে।
‘আর খেলবেন না?’
‘না।’
ক্যাথিকে নিয়ে ক্যাশিয়ারের কাউন্টারের দিকে এগোল রানা। ষোলোটা হাজার ডলারের নোট গুণে নিল ক্যাথি দুই তিনবার করে। তারপর সেগুলো কালো ভ্যানিটি ব্যাগে পুরে আবার এসে বসল রানার সঙ্গে কোণের সেই টেবিলটায়। হাতের ব্যাগটা সযত্নে রাখল সে টেবিলের মাঝখানে।
নিজের জন্য একটা স্কচ এবং ক্যাথির জন্যে আরেকটা মার্টিনি অর্ডার দিয়ে রানা বলল, ‘আপনার কপালটা সত্যিই ভাল।’
‘আমার কপাল মানে? খেললেন তো আপনি—আমি তো কেবল আপনার কথা মত কাজ করলাম।’
‘যাই হোক, আপনার কপালেই তো হলো। এখন আমার চার হাজার ডলার শোধ করে দিন।’
‘সবই আছে ব্যাগে। বের করে দেব?’ ব্যাগে হাত দিল ক্যাথি।
‘না, না। সব কেন? আমার টাকা আমাকে দিয়ে দিন। আপনি খেলে যা জিতেছেন—ও টাকা আপনার। আমাকে দেবেন কেন?’
অবাক হয়ে রানার চোখের দিকে চাইল ক্যাথি ডেভন। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে গেছে–চোখ দুটো বিস্ফারিত। কথাগুলো যেন ঠিক বুঝতে পারল না সে। বারো হাজার ডলার!
এ কী সম্ভব? বলল, ‘যাহ, ঠাট্টা করছেন!’
‘ঠাট্টা নয়, সত্যি। বারো হাজার ডলার দরকার বলছিলেন না? সেই বারো হাজার আজ নিজেই উপার্জন করে নিলেন আপনি।’
বিস্মিত, বিমূঢ় ক্যাথি ধীরে ধীরে বুঝল কেন ওকে আজ এখানে নিয়ে এসেছে মাসুদ রানা। কেন জোর করে ওকে ধার দিয়েছে চার হাজার ডলার। তারপর যেন এটাকে ও অপরিচিত বিদেশীর অযাচিত দান বলে প্রত্যাখ্যান করতে না পারে সেজন্য তাকে দিয়েই খেলানো হয়েছে সবটা খেলা। কথাটা ঠাট্টা নয়। তাকে দশ বছরের দুর্বিষহ দায় থেকে মুক্ত করে দিয়েছে ওই নিষ্ঠুর, দুর্ধর্ষ চেহারার পাকিস্তানী স্পাই। হঠাৎ এক অদম্য আবেগে উথলে উঠল ক্যাথির বুকের ভিতরটা।
টেবিলের কিনারা ধরে না ফেললে হয়ত পড়েই যেত ক্যাথি। দুই কনুই টেবিলের ওপর রেখে দুই হাতে দুই গাল ধরে নিজেকে স্থির রাখতে চেষ্টা করল সে। তারপর হঠাৎ দুই চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গিয়ে। টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ল প্লাস্টিক ঢাকা টেবিলের ওপর হাতের তালু বেয়ে। একটা ওয়েটার তাই দেখে এগিয়ে আসছিল, হাতের ইশারায় তাকে সরে যেতে বলল রানা। এক মিনিটের মধ্যেই সামলে নিল ক্যাথি। চোখ মুছে নিয়ে বলল, ‘মাফ করবেন। নিজেকে সামলাতে না পেরে এক বিশ্রী সিন ক্রিয়েট করলাম। কিন্তু কেন আপনি এটা করলেন? কেন আমার মত একটা নিঃস্ব মেয়েকে হঠাৎ এমন প্রাচুর্যে ভরিয়ে দিলেন? অদ্ভুত লোক আপনি। আপনি বুঝতে পারবেন না, মি. মাসুদ রানা, আমার কেমন লাগছে। এত টাকা সব আমার! বাবার কেমন লাগবে? উহ্! আর উইলিয়াম!’ বলতে বলতে আবার দুই বিন্দু জল নেমে এল গাল বেয়ে।
মৃদু হেসে উইস্কিতে চুমুক দিল রানা। চেয়ে চেয়ে দেখল ও প্রায় অচেনা একটা বিদেশি মেয়ের উদ্বেগ, বিস্ময়, উত্তেজনা ও আনন্দাশ্রু। তারপর ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, ‘পৌনে আট। ওঠার সময় হলো। ওটুকু শেষ করে চলুন উঠে পড়ি।’ বিল চুকিয়ে দিল রানা।
গ্লাসের তলায় পড়ে থাকা জলপাইটা কাঠি দিয়ে তুলে মুখে পুরল ক্যাথি ডেভন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘চলুন।’
হোটেলের সামনে রানাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল ক্যাথি দুই ডানা মেলে ভবিষ্যৎ সুখ কল্পনায় ভাসতে ভাসতে। জীবনের সবকটা দিন যদি এমনি সুখের হত!
ঘরে ঢুকেই রানা বুঝল ওর অনুপস্থিতিতে কেউ ঢুকেছিল ঘরের ভিতর। জিনিসপত্র যেমন রেখেছিল ঠিক তেমনটি আর নেই। খোয়া যায়নি কিছুই—কিন্তু সমস্ত জিনিসপত্র ঘেঁটেছে কে যেন। চোর হলে তো চুরি করত। তা হলে? ব্যাপারটা আবছাই থেকে গেল রানার কাছে।
রাতে, বিছানায় শুয়ে, রানা ভাবল মিত্রার কথা। কেন যে ঘুরেফিরে বারবার এই মেয়েটির ছবি ভেসে ওঠে মনের পর্দায় বুঝতে পারে না রানা। কেন অবসর পেলেই নিজের অজান্তে ওর কথা ভাবতে থাকে ও? দেখা হবে আর কোনদিন? কেন যে এমন হয়—হঠাৎ কেন এমন ফাঁকা লাগে? রানার জীবনে কোথায় যেন একটা মস্ত গলদ রয়ে গেছে। বুঝতে পারে না ও অনেক ভেবেও, ত্রুটিটা ঠিক কোনখানটায়।