৩১ আগস্ট, ১৯৬৫
‘চোখ বন্ধ করো; মিত্রা।’
গম্ভীর কণ্ঠ রানার। হাতে তার ওয়ালথার পিপিকে। নলটা আরও কয়েক ইঞ্চি বড় হয়ে গেছে সাইলেন্সর লাগানোতে। চোখ বন্ধ করল মিত্রা। ধড়মড় করে বিছানা থেকে লোকটার ওঠার শব্দ পাওয়া গেল। দুপ। একটা মৃদু গম্ভীর শব্দ। তারপরই একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। ধড়াস করে আছড়ে পড়ল মাটিতে ভারী কিছু।
‘শিগগির বাইরে চলে এসো। মাটির দিকে চেয়ো না।’
তাবু থেকে বেরিয়েই এক দৌড়ে একটা আমগাছ তলায় এসে দাঁড়াল ওরা। রানা বলল, ‘চিৎকার শুনে এক্ষুণি আরও লোক এসে পড়বে। কোয়ার্টার মাইল দূরে মোটরসাইকেল। পালাতে হবে এখন জলদি।’
কথাটা শেষ হতে না হতেই তিন দিক থেকে টর্চ জ্বলে উঠল। গর্জে উঠল তিনটে রিভলভার। চট করে আমগাছের আড়ালে সরে গেল রানা মিত্রাকে নিয়ে, তারপর একটা টর্চ লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল।
বাপস! মোটা কর্কশ গলার আওয়াজ এল। গুলি গিয়ে ঢুকল একটা টর্চের মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গেই নিভে গেল সব টর্চ রানার অব্যর্থ গুলির ভয়ে। কিন্তু আরও একবার গর্জে উঠল তিন রিভলভার। মিত্রাকে নিয়ে মাটির ওপর দিয়ে বুকে হেঁটে সরে গেল রানা বেশ অনেকটা বাম দিকে। আগেই রাস্তার দিকে গেল না। বিশগজ ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে রাস্তা। তিনজনই আশা করবে রানা ওই পথে যাবে। গুলি এড়িয়ে রাস্তায় ওঠা সহজ হবে না।
গাছের আড়ালে চলে গেছে চাঁদ। মিনিট দুয়েক চুপচাপ থেকে একটা টর্চ হঠাৎ রাস্তার দিকে একবার ফোকাস করেই নিভে গেল। সেই আলোয় রানা দেখল, গলির মুখের কাছাকাছি মেশিনগানধারী যে লোকটাকে কায়দা করে ও বন্দি করেছিল, সেই লোকটা কোনও রকমে হাত-পায়ের বাঁধন খুলে তাঁবুতে ফিরে আসছে।
তিনটে রিভলভার গর্জে উঠল একসঙ্গে। ঢিল খেলে কুকুর যেমন শব্দ করে ঠিক তেমনি একটা শব্দ করে বসে পড়ল লোকটা মাটিতে। রানা এবার দ্রুত বাম দিকের ঝোঁপঝাড়ের দিকে সরতে থাকল। দুটো টর্চ জ্বলে উঠল এবার অনেকটা নির্ভয়ে। ইচ্ছে করলে তিনজনকেই শেষ করে দিতে পারে রানা, কিন্তু তা না করে চুপচাপ মাটির সঙ্গে সেঁটে থাকল। রানার কয়েক ফুট পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল তিনজন আহত লোকটার দিকে। মাটিতে পড়ে ছটফট করছে বটে, কিন্তু গুলি করতে পারে ভেবে আরও কয়েক রাউণ্ড গুলি করল ওরা গজ দশেক দূরে দাঁড়িয়ে। একেবারে স্থির হয়ে যেতেই এগিয়ে গেল সামনে।
রানা ততক্ষণে মিত্রার হাত ধরে জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে রাস্তায় গিয়ে পড়েছে। মিনিট পাঁচেক, একটানা ছুটে একটা ঝোঁপের ধারে দাঁড়াল রানা। মোটরসাইকেলটা নিয়ে এল ওধার থেকে।
একটু দ্বিধা করল মিত্রা মোটরসাইকেলের পেছনে উঠতে। টাইমবম্বটার কথা মনে হলো। কিন্তু আর তো উপায় নেই এখন। কাঁচা রাস্তা দিয়ে যতদূর তাড়াতাড়ি সম্ভব এগিয়ে চলল ওরা বড় রাস্তার দিকে।
‘বড় রাস্তায় বাস-টাস পাওয়া যাবে না?’ জিজ্ঞেস করল মিত্রা।
‘এত রাতে কোথায় কিভাবে বাস পাবে? আর বাসের দরকারই বা কী? এই ষাট মাইল যেতে বড় জোর সোয়া ঘণ্টা লাগবে হোণ্ডায়।’
‘না, মানে, আমরা কোনও ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে তো লুকিয়ে থাকতে পারি রাতটা। সকালে না হয় বাসে ফেরা যাবে রাজশাহী।’
‘হঠাৎ বাসের প্রতি তোমার এত ভক্তি কেন, মিত্রা?’ হেসে জিজ্ঞেস করল রানা।
কোনও উত্তর দিল না মিত্রা। ওর অস্বস্তিটা মনে মনে উপভোগ করছে রানা। বড় রাস্তায় উঠল ওরা। হেড-লাইট জ্বেলে দিয়ে মাইল মিটারের দিকে চেয়ে বলল, ‘সিক্সটি ফাইভ।’
পেছনে শক্ত করে রানার কাঁধ ধরে বসে আছে মিত্রা। বাতাসে ওর চুল উড়ে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে রানার গলায়।
‘মোটরসাইকেলটা আমাদের ত্যাগ করা উচিত,’ বেশ কিছুক্ষণ উসখুস করে বলল মিত্রা।
‘কেন, বলো তো!’
‘তুমি জানো না, এতে টাইমবম্ব ফিট করা আছে। অল্পক্ষণেই ফাটবে।’
‘টাইমবম্ব? তা, এতক্ষণ বলোনি কেন?’ আশ্চর্য হয়ে গেল রানা। কিন্তু মোটরসাইকেলের স্পীড কমাল না একটুও।
‘সেই কখন থেকেই তো বলছি, শুনছ তো না। আর শুনেও তো থামাচ্ছ না!’ উদ্বেগ প্রকাশ পেল মিত্রার কণ্ঠে।
‘ওটা এখন আমার পকেটে।’ নির্বিকার চিত্তে জবাব দিল রানা।
‘হাঁ হয়ে গেল মিত্রা। ভাবল, সাঙ্ঘাতিক ধুরন্ধর লোক তো ব্যাটা! নইলে আর এত নাম! আমাদের সার্ভিসে এর মতন একটা লোকও যদি থাকত। এতবড় বুকের পাটা আর এমন প্রশস্ত মন!’
‘তুমি ঠিক সময় মত গিয়ে না পৌঁছলে আমার কী যে অবস্থা হোত! মেশিনগানের আওয়াজ শুনে আমি তো সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।’
‘হ্যাঁ, আমিও তাই চেয়েছিলাম। পেছন থেকে গিয়ে ব্যাটাকে কাবু করে ফেলে ফাঁকা আওয়াজ করেছিলাম যাতে সবাই নিশ্চিন্ত থাকে আমার মৃত্যু সম্পর্কে।’
‘উহ! তুমি মনে করে কী নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল ওরা ওই লোকটাকে!’
মাইল মিটারের কাটা একেকবার সত্তরের ঘরে গিয়ে থর থর কাঁপছে–আবার খারাপ রাস্তায় চল্লিশ এমনকী তিরিশে আসছে নেমে। জোর বাতাসে আঁচল উড়ছে মিত্রার। সামনের রাস্তাটা আলোকিত করে এগিয়ে চলেছে ওরা। পেছনে বিশাল অন্ধকার যেন গ্রাস করতে চাইছে ওদের। তেড়ে আসছে হিংস্র নখদন্ত বের করে, কিন্তু ধরতে পারছে না ওদের, পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে ওরা সামনে। আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে তারার চোখে নীল আলো। মুক্তির আনন্দে মিত্রা বলছে জয়দ্রথের চক্রান্তের কথা–কিন্তু বেশ কিছু রেখে ঢেকে।
‘তা হলে এই ছিল প্ল্যান? আমাকে হত্যার বিনিময়ে ওরা পাচ্ছিল তোমাকে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আহ্-হা। আমি যদি পেতাম এমন সুযোগ। সব শালাকে সাফ করে দিতাম।’
‘বুঝলাম, মস্ত বীরপুরুষ তুমি। কিন্তু আমাকে নিয়ে কী করতে? বৌ ছেলেমেয়ে নেই?’
‘নাহ্। প্রথমটাই হলো না—শেষেরগুলো আসবে কোত্থেকে?’
‘বিয়ে করোনি কেন?’
‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না। তা ছাড়া আমার এই বিপজ্জনক জীবনে কে আসবে? মেয়েরা বড় হিসেবী।’
‘ভুল করে চেয়েছিলে কাউকে?’
‘চেয়েছি।’
‘কাকে?’
‘শুনে তোমার লাভ? ভাবছ গদগদ কণ্ঠে তোমার নাম বলব, না? আর কলকাতায় ফিরে পাকিস্তানী এক ছোঁড়াকে পাগল করে দিয়ে এসেছ ভেবে অনাবিল আনন্দ লাভ করবে। সেটি হচ্ছে না।’
‘তুমি একটা ছোটলোক।’
কথাটা বলেই কাঁধ ছেড়ে দিয়ে আলতো করে রানার মাথার পেছনে চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে দিল মিত্রা। কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে একমুঠি চুল আলগা করে ধরে ঝাঁকিয়ে দিল রানার মাথাটা। আবার বলল, ‘তুমি একটা ছোটলোক।’
একটু পরেই চমকে উঠল মিত্রা। পিছন থেকে একটা গাড়ি আসছে না?
‘রানা!’ ভয়ে কেঁপে উঠল মিত্রার কণ্ঠস্বর। ‘ওরা আসছে পিছন পিছন।’
‘রিয়ারভিউ-মিররে অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি। বিপদেই পড়া গেল। এগিয়ে আসছে ওরা ফুল স্পীডে। আমরা চল্লিশের বেশি স্পীড তুলতে পারছি না। আর দশ মিনিটেই ধরে ফেলবে ওরা আমাদের।’
‘তা হলে উপায়?’ উৎকণ্ঠিত মিত্রার কণ্ঠে স্পষ্ট হতাশা। জবাব দিল না রানা, দ্রুত চিন্তা চলছে ওর উর্বর মস্তিষ্কের ভিতর।
ধীরে ধীরে পেছনের হেড-লাইটের আলো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আর কোনও উপায় নেই। একটা পিস্তল নিয়ে মেশিনগানের বিরুদ্ধে লড়তে যাওয়া বাতুলতা ছাড়া কিছুই নয়। এগিয়ে আসছে জীপ। এবার নিশ্চিত মৃত্যু।
হঠাৎ সামনের হ্যাণ্ডেল থেকে মিলিটারি মডেলের বড় ওয়াটার বটলটা নিয়ে মিত্রাকে দিল রানা। বলল, ‘এর মুখটা খুলে ভেতরের পানি সব ফেলে দাও তো, মিত্রা।’
‘এটা দিয়ে কী হবে?’ জিজ্ঞেস করল মিত্রা।
‘প্রশ্ন নয়, যা বলছি তাই করো। জলদি!’ গম্ভীর রানার কণ্ঠ। পানি ফেলে দিল মিত্রা কর্ক খুলে।
হঠাৎ ডাইনের মোড়টা ঘুরেই লাইট অফ করে দিয়ে কষে ব্রেক চাপল রানা। দু’হাতে জড়িয়ে ধরল ওকে মিত্রা। কয়েক গজ গিয়েই থেমে গেল ভারী মোটরসাইকেল। স্ট্যাণ্ডে তুলে দিয়ে মিত্রার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে টান দিয়ে ফুয়েল পাইপটা খুলে ফেলল সে। বোতলটা ধরল পাইপের মুখে। দ্রুত নেমে আসতে থাকল পেট্রোল।
পিছনের গাড়িটা একেবারে কাছে এসে পড়েছে এবার। ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। হেড-লাইটের আলোয় রাস্তার সোজাসুজি মস্ত ছাতার মত ছাতিম গাছটা, আলোকিত। দ্রুত এগিয়ে আসছে ওরা। এক্ষুণি এসে পড়বে। আর অপেক্ষা করা যায় না। বোতলটার চারভাগের তিনভাগ ভরতেই পেট্রোল শেষ হয়ে গেল ট্যাঙ্কের। মিত্রার হাত ধরে এবার দৌড়ে রাস্তার ডানদিকের একটা শুকনো নালা পেরিয়ে ঝোঁপের ধারে সজনে গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল রানা। পকেট থেকে রুমাল বের করে ভিজিয়ে নিল পেট্রোলে। রুমালের অর্ধেকটা ঢুকিয়ে দিল পেট মোটা ওয়াটার-বটলের মধ্যে, বাকি অর্ধেক বাইরে বের করে রেখে ওটার মুখে কর্ক এঁটে দিল শক্ত করে। মুখে বলল, ‘মলোটভ বম্ব।’
মোড় ঘুরেই ব্রেক করল জীপটা রাস্তার মাঝখানে মোটরসাইকেল দেখে। রাস্তার উপর দিয়ে হেঁচড়ে কিছুদূর গিয়ে পিছন দিকটা স্কিড করে একটু বাঁয়ে হেলে থামল জীপ। তিন সেকেণ্ড থমকে থাকল। তারপর এক পশলা গুলি বর্ষণ করল মোটরসাইকেলটার ওপর।
একটা শেয়াল বোধহয় এতক্ষণ গোপনে লক্ষ্য করছিল রানা ও মিত্রার সন্দেহজনক কার্যকলাপ। গুলির শব্দে হাত পাঁচেক দূরের একটা ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে দৌড় দিল। পাতার ওপর মচমচ শব্দ হতেই আবার গর্জে উঠল মেশিনগান। একটা চিৎকার করেই পড়ে গেল শেয়ালটা মাটিতে।
এবার একজনের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল— ‘উতারো স্যব গাড়িসে! ঢুণ্ডকে নিকালো উও কুত্তাকো।’
খট করে শব্দ হলো রানার লাইটারের। রুমালের এক কোণে আগুনটা ছুঁইয়ে দিয়েই ছুঁড়ে মারল ও বোতলটা গাড়ির ওপর। আলো দেখেই আবার ক্রুদ্ধ গর্জন করে উঠল বেরেটা মেশিনগান। নরম সজনে গাছের গায়ে ফুটো হয়ে গেল অনেকগুলো।
ব্যাপারটা বোঝার আগেই রানার আগুনে বোমাটা গিয়ে পড়ল জীপের ভিতর। বিস্ফোরণের শব্দ হলো একটা। দাউ দাউ করে আগুন ধরে গেল গাড়িতে। সর্বাঙ্গে আগুন লেগে গেছে ভেতরের লোকগুলোর। হতবুদ্ধি হয়ে গিয়ে পাগলের মত চিৎকার করছে চারজন ইয়াং টাইগার। সারা শরীরে আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই আরেকটা বিস্ফোরণের শব্দ হলো। জীপের পেট্রোলট্যাঙ্ক বাস্ট করল। নরক কুণ্ড জ্বলে উঠল যেন। আগুনের লেলিহান শিখা উঠল পঁচিশ-তিরিশ হাত উঁচু পর্যন্ত। সেই উত্তাপের হল্কা এসে লাগল রানা ও মিত্রার মুখে। মাংস পোড়া গন্ধ ছুটল চারদিকে। এ ভয়ঙ্কর দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে চোখ ঢাকল মিত্রা।
বহু কষ্টে এক ছোকরা জীপ থেকে বেরোল। মশালের মত আগুন জ্বলছে ওর সারা দেহ ঘিরে। একটা চুলও নেই মাথায়। দু-তিন পা এগিয়েই আছাড় খেল রাস্তার উপর। বীভৎস দৃশ্য।
আগুন একটু কমলে পর মোটরসাইকেলটা স্ট্যাণ্ড থেকে নামাল রানা। ঠেলে আরও কয়েক গজ দূরে নিয়ে গেল আগুন থেকে।
‘ট্যাঙ্কে তো আর পেট্রোল নেই। এখন ফিরব কী করে?’ মিত্রা জিজ্ঞেস করল।
উত্তর না দিয়ে ফুয়েল পাইপটা যথাস্থানে লাগিয়ে নিয়ে রিজার্ভ ট্যাঙ্কের চাবি খুলে দিল রানা। স্টার্টার বাটুন টিপতেই মৃদু গর্জন করে চালু হয়ে গেল ফোর স্ট্রোক ইঞ্জিন।
আবার হু হু করে বাতাস কেটে অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে চলল ওরা রাজশাহীর দিকে। আরও বিশ মাইল আছে। মনটা খারাপ হয়ে গেছে রানার। বিয়োগান্ত নাটক দেখে বেরিয়ে এসেছে যেন। জোর করে দূর করে দিল ও মন থেকে দুঃস্বপ্নের মত ঘটনাগুলোর স্মৃতি।
চাঁদ ডুবে গেছে। জ্বলজ্বল করছে শুভ্র তারাগুলো, যেন শিশির ভেজা। থেকে থেকে হাসনাহেনা, শিউলি আর ছাতিমের ভারী সুগন্ধ জমাট বেঁধে আছে রাস্তার উপর। একটা নক্ষত্র খসে পড়ল।
‘রানা।’
‘বলো।’
‘যখন তারা খসে পড়ে তখন নাকি মনে মনে যে যা চায় তাই পায়? তুমি বিশ্বাস করো একথা?’
‘তুমি নিশ্চয় করো? কী চাইলে শুনি?’
‘তোমাকে।’ গালটা রাখল সে রানার পিঠের উপর।
‘তথাস্তু।’ খোদ ভগবানের মত বলল রানা। তারপর হাসল।
‘রানা।’ আবার ডাকল মিত্রা একটু পর।
‘কী বলছ?’
‘তোমার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলাম, তুমি দিয়েছ। আমার কাছে কি তোমার কিছুই চাওয়ার নেই?’
‘আছে, যা চাইব দেবে?’
‘তোমার জন্যে সব দিতে পারি আমি এখন।’
‘সত্যিই?’
‘সত্যি। কী চাও তুমি বলো?’
‘ইনফরমেশন।’
কেউ যেন কালি মাখিয়ে দিল মিত্রার মুখে। এক মুহূর্তে বাস্তব জগতে ফিরে এল সে। পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মাসুদ রানা ইনফরমেশন চাইছে ইণ্ডিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের মিত্রা সেনের কাছে। কথা দিয়েছে সে। এখন ফেরাবে কী করে? চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ।
‘দ্বিধা হচ্ছে, মিত্রা?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘হ্যাঁ। নিজের স্বার্থে জয়দ্রথের বিরুদ্ধে, দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমার কাছে সাহায্য চেয়েছি আমি রানা। কেবল নিজেকে রক্ষা করবার জন্যে। তোমার বিরুদ্ধে জয়দ্রথের চক্রান্ত সফল হলো না আমি স্বার্থপরের মত বিশ্বাসঘাতকতা করলাম বলে। অদ্ভুত এক মানসিক পীড়ায় ভুগছি আমি, রানা। আমার বিবেক ছিন্নভিন্ন করছে আমাকে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে আমি অন্যায় করেছি। তবু সান্ত্বনা ছিল—নিজেকে রক্ষা করবার অধিকার সবার আছে। কিন্তু তোমাকে যদি আমি কোনও ইনফরমেশন দিই তবে কোনও সান্ত্বনাই আর থাকবে না আমার, রানা। তোমাকে কথা দিয়েছি, যদি বলো দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতিনী হতে…’
‘থাক তা হলে।’
‘আমাকে ক্ষমা করো, রানা। তা ছাড়া আমার কাছ থেকে বিশেষ কিছু…’
‘বেশ, ক্ষমা করে দিলাম।’
‘আর কিছু চাইবে না?’
‘না।’
‘আমি যদি কিছু দিই গ্রহণ করবে?’
‘দিয়েই দ্যাখো না!’
তীরের মত বাতাস ভেদ করে এগিয়ে চলল শক্তিশালী দ্বিচক্র যান। এসে পড়েছে রাজশাহী। সারি সারি বন্ধ দোকানপাট আর দালান-কোঠা ছাড়িয়ে চলল ওরা ডাকবাংলোর দিকে। মোটরসাইকেলটা ডাকবাংলো থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছেড়ে দিয়ে নিঃশব্দ পায়ে উঠে এল ওরা দোতলায়। সারা ডাকবাংলো ঘুমে অচেতন। ঘড়িতে বাজে চারটে।
প্রথমেই পিস্তলটা পরিষ্কার করল রানা যত্নের সঙ্গে। আরও দুটো গুলি ভরে নিল ম্যাগাজিনের মধ্যে। শরীরে ক্লেদাক্ত ক্লান্তি। আবারও গোসল করল রানা। একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের সঙ্গে লাগানো ছোট্ট ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। গোটা শহরটা নিঝুম ঘুমে আচ্ছন্ন। দূরে লাইট পোস্টের আলোর চারধারে কতগুলো পোকা ঘুরছে অনবরত। অনেক কথা ভাবছে সে। অনেক অনেক পুরনো কথা।
খুট করে একটা শব্দ হলো ঘরের ভিতর। মাঝের দরজাটা খুলে মিত্রা এসে দাঁড়াল রানার পাশে। মিষ্টি একটা সেন্টের সুবাস ওর দেহে। মুখে সযত্ন প্রসাধন।
‘কী মিত্রা, ভয় করছে?’
‘না।’ চাপা গলায় ছোট্ট উত্তর।
‘তবে?’
‘একা একা ভাল্লাগছে না। ঘুম আসছে না কিছুতেই।’
রানার একটা হাত তুলে নিল মিত্রা ওর হাতে। গালের ওপর রাখল কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ চেপে ধরল সেটা বুকের উপর।
‘চলো, ঘরে গিয়ে গল্প করি দুজন।’ মৃদু টান দিল সে রানার হাত ধরে।
এক মুহূর্তে অনেক কিছু বুঝে নিল রানা। তাকাল মিত্রার মুখের দিকে। মাথাটা নীচু করল মিত্রা। চিবুক ধরে মিত্রার লজ্জিত মুখটা উঁচু করল রানা। চোখে চোখে চেয়ে থাকল দু’জন। রানা দেখল উদগ্র কামনায় জ্বলছে নারীর চোখ।
দূরের লাইট পোস্ট থেকে ম্লান আলো এসে পড়েছে। চিক চিক করছে মিত্রার আধবোজা ভীরু চোখ। শেষ রাতের শিশির ভেজা অন্ধকারকে শিউরে দিয়ে কাছেই কোনও বাড়িতে কেঁদে উঠল একটি শিশু।
ওরা দুজন হাসল। ঠাণ্ডা এক দমকা বাতাস এসে দুলিয়ে দিল মিত্রার শাড়ির আঁচল। ব্যালকনি ছেড়ে ঘরে চলে এল ওরা।
আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে এল মিত্রা। আলতো করে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল রানা ওর বিবশ দেহ।
তিন ওয়াটের নীল বাতিটা চেয়ে চেয়ে দেখল, এক সময় ফুঁপিয়ে উঠে দুই হাতে চোখ ঢাকল মিত্রা সেন।
সকাল আটটায় ঘুম ভাঙল রানার। পাশে কেউ নেই। পাশের ঘরেও কেউ নেই। সারা ডাকবাংলোতে মিশনের কেউ নেই। ভোজবাজির মত যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে সাংস্কৃতিক মিশনের গোটা দলটা।