২৯ আগস্ট, ১৯৬৫
সকালে প্রবল করাঘাতের শব্দে ঘুম ভাঙল রানার। দরজা খুলে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে জয়দ্রথ মৈত্র। ভূত দেখার মত চমকে উঠল জয়দ্রথ ও রানা একইসঙ্গে। হলুদ দৃষ্টি রানার চোখের ওপর স্থির হয়ে গেল। ডান দিকের ঘা-টা চাটল জয়দ্ৰথ মৈত্র।
‘আপনি এ ঘরে কেন?’ দৃষ্টিটা রানার চোখ থেকে সরে গিয়ে সারা ঘরে একবার ঘুরে জানালার ওপর থমকে দাঁড়াল, তারপর আবার স্থির হলো এসে রানার মুখে। ঠিক এমনি সময় মিত্রা এসে ঘরে ঢুকল বাথরুমের দরজা দিয়ে। জয়দ্রথের চোখে কুৎসিত একটা সন্দেহের ছায়া দেখতে পেল মিত্রা। মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চাইল ওর।
গম্ভীর মুখে সব শুনল জয়দ্রথ মৈত্র। কতটুকু বিশ্বাস করল আর কতটুকু ইচ্ছেমত যোগবিয়োগ করে নিল কে জানে। সবশেষে রানার দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনার কাছে আমরা আন্তরিক কৃতজ্ঞ, মি. তরিকুল ইসলাম। আপনার সাহায্যের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, রাতেই আমাকে জানানো উচিত ছিল তোমার।’ ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে একটু থেমে পেছনে না ফিরেই বলল, ‘আমার ঘরে একটু শুনে যেয়ো, মিত্রা।’ তারপর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
‘তোমাদের সব ধরে ধরে ইয়ে করা দরকার। বুঝছ? এটা কি চা হয়েছে, না কানা চোখের পানি?’ সোহেলের হাতে ট্রের ওপর চায়ের কাপের দিকে চেয়েই গর্জে উঠল মাসুদ রানা।
নাস্তার এঁটো তস্তরি-বাসন তুলতে তুলতে নিচু গলায় সোহেল বলল, ‘নে, ইয়ার্কি রাখ। আজ দুপুরে ওরা সব চলল শিলাইদহ দেখতে। তুই যাবি নাকি?’
কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল রানা। তারপর বলল, আমাকে ওরা চিনে ফেলেছে বলছিলি না কাল তুই?’
‘হ্যাঁ।’
‘আর তোকে? তোর ওপর কোনও সহেন্দ হয়নি তো ওদের?’
‘না। এখনও হয়নি!’
‘তা হলে আমি যাব শিলাইদহে।’
‘সন্দেহের সঙ্গে শিলাইদহের কী সম্পর্ক?’ অবাক হলো সোহেল।
‘সম্পর্ক আছে। শোন বলছি। আমি ওদের সঙ্গে যদি শিলাইদহে যাই তবে ওরা এদিকটায় অত কড়া পাহারা দেবে না। পাঁচ নম্বর রুমে ওদের কী আছে আমার জানা দরকার। কিন্তু সব সময় ওদের লোক ঘরটা এত কড়া পাহারায় রাখে যে কোনরকমে ভিড়তেই পারছি না কাছে। তুই যখন বলছিস তোর ওপর ওদের কোনও সন্দেহ নেই, যত সন্দেহ এই আমার ওপর, তখন আমি ওদের সঙ্গে শিলাইদহ গেলে ওই ঘরটার ব্যাপারে ওরা নিশ্চিন্ত থাকবে। আর সেই সুযোগে তুই ঢুকবি ওই ঘরে, দেখে আসবি কী চলছে গোপনে ওই নিষিদ্ধ ঘরটার মধ্যে। কী বলিস, পারবি না?’
‘যো হুকুম, ওস্তাদ।’
সেদিন, অর্থাৎ ২৯ আগস্ট দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে সবাই দল বেঁধে বেরোল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠি দেখতে। রানাও গেল। মিত্রাও। কিন্তু মিত্রা যেন সেই গতরাতের সহজ সাবলীল মিত্রাই নয়। সারা মুখে থমথমে গাম্ভীর্য। চোখ দুটো কেমন উদ্ভ্রান্ত। রানার সঙ্গে একটি বাক্য বিনিময়ও যেন না হয় সেদিকে কেবল জয়দ্রথ কেন, দলের প্রত্যেকটি লোক এবং স্ত্রীলোক সতর্ক দৃষ্টি রাখল। মিত্রার সঙ্গে কথা বলবার সুযোগ হলো না। শুধু এটুকু লক্ষ্য করল রানা, গভীর চিন্তামগ্ন মিত্রা সেন থেকে থেকে ওর দিকে চাইছে দূর থেকে। ও চাইলেই চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে অন্য দিকে। অনেক চিন্তা করেও যেন কোনও একটা কঠিন সমস্যার সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না মিত্রা।
লঞ্চঘাটে নেমে পায়ে হেঁটে এগোল ওরা। হাতের বাঁয়ে পড়ল রবীন্দ্রনাথের পোস্টাপিস বা ডাকঘর। এখানে নিজস্ব ব্যাংকও নাকি স্থাপন করেছিলেন তিনি। আরও কিছুদূর এগিয়ে দূর থেকে দোতলা কাছারি বাড়ি দেখা গেল, কিন্তু সেদিকে না গিয়ে ডান দিকে মোড় ঘুরল ওরা। কুঠি বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকেই ডান দিকে বিরাট আম বাগান, বায়ে কিছু খেত ও ঝাউয়ের বন। সোজা এগিয়ে দেখা গেল সুন্দর বাংলো টাইপ পাকা দোতলা বাড়ি, ওপরটা টালি দেয়া। ফুলের বাগান ছাড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই হলঘর। পাল্কিটা সত্যিই দেখবার মত। অল্পস্বল্প আসবাবপত্র আছে—কয়েকটা আলমারিতে রয়েছে কিছু বই। দোতলার ঘর আর ছাতের চিলেকোঠা দেখে দলবল এগিয়ে গেল আঙিনায় আম বাগানের সেই বিখ্যাত চাতাল দেখতে। হঠাৎ এদের সঙ্গ কেন জানি বড় তিক্ত লাগল রানার কাছে। পিছিয়ে পড়ল সে। বেরিয়ে এল বাইরে। ফুলের বাগান বায়ে রেখে এগিয়ে গেল পুকুরের দিকে। ডানধারে চাকরদের একতলা লম্বা ঘর। ঘাটের দুই ধারে মস্ত দুটো বকুল গাছ। বিকেল বেলাতেই চারদিকটা নিঝুম হয়ে এসেছে। পুকুরে স্নানার্থী নেই আর।
শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে চুপচাপ বসল গিয়ে রানা একা। ফ্লাস্ক থেকে চা। ঢেলে নিয়ে সিগারেট ধরাল একটা।
অদ্ভুত সুন্দর বিকেল। শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশের সাদা মেঘগুলো ছায়া ফেলেছে কানায় কানায় ভরা পুকুরটার কালো জলে। মৃদু বাতাসে ঝির ঝির শব্দ করছে ঝাউয়ের পাতা। চারদিকে স্নিগ্ধ, শান্ত, সমাহিত একটা ভাব।
বি.এ. ক্লাসে পড়া রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতার কটা লাইন মনে পড়ল রানার:
কাছে এল পূজার ছুটি।
রোদ্দুরে লেগেছে চাপা ফুলের রঙ।
হাওয়া উঠছে শিশিরে শিরশিরিয়ে,
শিউলির গন্ধ এসে লাগে
যেন কার ঠাণ্ডা হাতের কোমল সেবা।
আকাশের কোণে কোণে সাদা মেঘের আলস্য–
দেখে, মন লাগে না কাজে।
সেই মুহূর্তে ভুলে গেল রানা তার কাজের কথা, জয়দ্রথ মৈত্রের কথা, মিত্রার কথা। শহরের কর্মমুখর জীবনের বিচিত্র ঘাত-প্রতিঘাত থেকে হঠাৎ ছিটকে বেরিয়ে এসে এক অদ্ভুত পরিপূর্ণতাকে উপলব্ধি করল ও সমস্ত হৃদয় দিয়ে। অদ্ভুত। অদ্ভুত এক নিরবচ্ছিন্ন শান্তি বিরাজ করছে এই জগৎ জুড়ে।
পৃথিবীটা সত্যিই মায়াবী এক স্বপ্নের দেশ!
দুপুর বেলা ডাকবাংলোটা নিঝুম হয়ে গেল। দু’জন ছাড়া সাংস্কৃতিক মিশনের বাকি সবাই চলে গেছে শিলাইদহ দেখতে, রানা গেছে সঙ্গে। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল সোহেল একজন বিছানায় শুয়ে এবং অপর জন বিছানার পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে ‘হানিমুন ব্রিজ’ খেলছে। চেয়ারে বসা লোকটার হাতে একটা অনার্স কার্ডও নেই—কিন্তু হাঁক ছাড়ল: ফোর নো ট্রাম্পস।
আস্তে ঘরের শিকলটা তুলে দিল সোহেল বাইরে থেকে। তারপর একগোছা চাবি হাতে নিয়ে দাঁড়াল সেই নিষিদ্ধ ঘরটার সামনে। কয়েকটা চাবি দিয়ে চেষ্টা করার পর একটা চাবি লেগে গেল তালায়।
বেশ বড় ঘর। একটা আলমারি আর ছোট একটা টেবিলের দু’ধারে দুটো চেয়ার ছাড়া আর কোনও আসবাব নেই। ঘরের মধ্যে এলোমেলো করে ছড়ানো স্টেজ ডেকোরেশনের সাজ সরঞ্জাম। কিন্তু বাক্সগুলো কিসের?’
প্রকাণ্ড সাইজের তিনটে বাক্স ক্যানভাসের তেরপল দিয়ে ঢাকা। তেরপল উঠিয়ে ডালা খুলল সোহেল। বড় সাইজের কাঁচা বেলের মত গোল সবুজ পেইন্ট করা অসংখ্য বল। বোম-টোম নাকি? তিনটে বাক্সেই একই জিনিস। হাতে তুলে নিল একটা। বেশ ভারী। টোকা দিয়ে দেখল ওপরটা প্লাস্টিকের।
সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও উল্লেখযোগ্য আর কিছুই পাওয়া গেল না। একটা বল হাতে বেরিয়ে এল সোহেল ঘর থেকে। বলটা দুই উরুতে চেপে ধরে তালা লাগিয়ে দিল আবার দরজায়।
জানতেও পারল না সে, আলমারির মাথায় নিখুঁত ভাবে লুকোনো একখানা সিক্সটিন মিলিমিটার মুভি ক্যামেরায় তার সমস্ত গোপন কার্যকলাপের ছবি উঠে গেল।
জয়দ্রথের মৃত্যু পরোয়ানা ঝুলল সোহেলের মাথার ওপর।
রাত তখন সাড়ে-বারোটা হবে। রানা শুয়ে আছে বিছানায়। ঘুম আসছে না কিছুতেই। আজ কুষ্টিয়ায় শেষ হয়ে গেল অনুষ্ঠান। আবার পাততাড়ি গুটিয়ে ভোর রাতের ট্রেনে রওনা হতে হবে রাজশাহীর পথে। পাশের ঘরে মিত্রা নেই। ওকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে অন্য ঘরে।
ইয়াং টাইগারস-এর দলটাকে সোহেল চিনিয়ে দিয়েছে দূর থেকে। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। আজকের রিপোর্ট পেয়ে রাহাত খান কেমন চমকে উঠবে ভাবতে ভাল লাগল রানার। স্যাম্পলটা রানার কাছেই আছে, ঈশ্বরদি পৌঁছে প্লেনে করে পাঠিয়ে দেয়া হবে ঢাকায়, হেড-অফিসে। এতদিন পর একটা কৃতিত্বপূর্ণ কাজ করবার সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়ে গেছে সোহেল। আনন্দে আত্মহারা। কিন্তু ওর জন্যে মনে মনে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারছে না রানা। কথায় কথায় সোহেল বলেছে— ‘আমিও ধরা পড়ে গেছি রানা। ওদের ব্যবহারেই টের পেয়েছি আমার পরিচয়। ওদের কাছে আর গোপন নেই। অবশ্য তাতে ক্ষতি নেই, আজই তো শালারা ভাগছে এখান থেকে আমার ডিউটিও এখানেই শেষ।’ কিন্তু রানা জানে সহজে ছাড়বার পাত্র জয়দ্রথ মৈত্র নয়।
ঠিক এমনি সময়ে গগনভেদী এক অপার্থিব চিৎকারে কেঁপে উঠল রাত্রির নিস্তব্ধতা। সোহেল না তো! একলাফে জানালার ধারে এসে দাঁড়াল রানা। ঠিক দশগজ দূরে আধো-অন্ধকারে ঘাসের ওপর পড়ে মৃত্যু-যন্ত্রণায় ছটফট করছে একজন লোক। পিঠের ওপর আমূল বিঁধে আছে একখানা ছোরা। লোকটার হাতেও ছুরি ধরা। সোহেলের মতই লাগছে না অনেকটা? আরে, ওই তো! দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে একটা মূর্তি। মাথায় খুন চেপে গেল রানার। একটানে পিস্তল বের করল ও হোলস্টার থেকে। এখনও রেঞ্জের বাইরে যায়নি আততায়ী।
ট্রিগারে আঙুল চেপে গুলি করবার ঠিক আগের মুহূর্তে থেমে গেল রানা। বিস্মিত দৃষ্টি মেলে দেখল দৌড়াবার সময় আততায়ীর একটা হাত দুলছে—আরেকটা হাত স্থির হয়ে ঝুলছে কাঁধ থেকে।
নিঃশব্দে জানালা থেকে সরে এল রানা।
বাইরে চিৎকার শুনে ছুটে আসা লোকজনের উচ্চকণ্ঠে আলাপ-আলোচনা নির্লিপ্ত ভাবে শুনতে শুনতে একসময় গভীর নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ল সে।
ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টা পড়ল। গার্ডের বাঁশি। হুইসল দিয়ে ছেড়ে দিল লোকাল প্যাসেঞ্জার ট্রেন। পোড়াদা-ভেড়ামারা-ঈশ্বরদি, তারপর আবদুলপুর-সারদা এবং সবশেষে রাজশাহী। মোট পঁচাত্তর মাইল।
রানা উঠে পড়ল সেকেণ্ড ক্লাস একটা কম্পার্টমেন্টে। সাংস্কৃতিক মিশনের রিজার্ভ করা সব শেষের দুই কামরার বগিতে কিছুতেই উঠতে দিল না ওকে জয়দ্রথ মৈত্র। কাজেই যতটা সম্ভব কাছের একটা কামরায় উঠতে হলো রানাকে। রানা লক্ষ্য করল সবশেষের কামরায় উঠেছে বাক্স তিনটে।
ব্রডগেজ লাইনে হু হু করে স্পীড বেড়ে গেল ট্রেনের। চার সিটের কামরা। দু’জন প্যাসেঞ্জার নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে বাঙ্কের ওপর। আর যে লোকটা অনেক ধাক্কাধাক্কির পর দরজা খুলে দিয়েছিল বিরক্ত মুখে, সে এখন পাশের সিটের ওপর পা চড়িয়ে দিয়ে আধশোয়া হয়ে ঢুলছে। জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে শেষের কামরার দিকে চাইল রানা।
পার্টিশন কিসের? রানা দেখল শেষ বগির দরজা দিয়ে স্টেজ ডেকোরেশনের একটা ক্যানভাস-পাটিশন বেরিয়ে আছে বাইরে। ব্যাপার কী? ওপাশের দরজা দিয়ে মাথা বের করে দেখল ওদিকেও ঠিক তাই। ফলে শেষের কামরাটা পুরো ট্রেন থেকে আড়াল হয়ে গেছে। কী হচ্ছে শেষ কামরায়? এখান থেকে বোঝার উপায় নেই।
আট মাইল পেরিয়ে এসে পোড়াদা স্টেশনে থামল ট্রেন। প্রায় লাফিয়ে নেমে এল রানা। দেখল পার্টিশনটা আর নেই। শেষ দুই কামরার পাশ দিয়ে এক চক্কর ঘুরে এল মাসুদ রানা। কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না তার। এদিকে হুইসল দিয়ে ছেড়ে দিল ট্রেন। প্রাণপণে দৌড়ে কোনরকমে বাদুড় ঝোলা হয়ে উঠল গিয়ে নিজের কামরায়।
ভোর হয়ে আসছে। পুবের আকাশটা বেশ ফর্সা হয়ে গেছে। হাল্কা কুয়াশায়। আচ্ছন্ন ফসল ভরা আদিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। আউশ ধান। মাঝে মাঝে গ্রাম দেখা যাচ্ছে। কুঁড়ে ঘর, উঠোনে খড়ের গাদা, আম কাঁঠাল আর কলা গাছ; মেঠেলের ধারে বাঁশের ঝাড়।
আবার জানালা দিয়ে পার্টিশন দেখতে পেল রানা।
সুটকেস থেকে একটা নাইলন কর্ড বের করল সে। কামরার কেউ জাগেনি এখনও। আধ-শোয়া লোকটার মুখ থেকে লালা ঝরছে গেঞ্জির উপর।
কামরায় উঠবার সুবিধের জন্যে যে লোহার হাতলটা থাকে তার সঙ্গে শক্ত করে বাঁধল রানা দড়ির এক প্রান্ত। ভারী দরজাটা খুলে হাঁ করে দিল। এবার খোলা দরজার ধারে বাইরের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াল। একবার ভাবল, তার দেহের ওজন সহ্য করতে পারবে তো কর্ডটা? পারবে। হাঁটু সোজা রেখে রশিটা একটু একটু করে ছেড়ে ধীরে ধীরে বাইরের দিকে শুয়ে পড়ল ও চিত হয়ে। মাটি থেকে সমান্তরাল ভাবে রয়েছে ওর দেহ। হু হু বাতাস আর সেই সঙ্গে প্রচুর ধুলিকণায় শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। ডান চোখের ভিতর বুলেটের বেগে একটা কাঁকর এসে পড়ল। বেশিক্ষণ এই ভাবে থাকা সম্ভব নয়। যে-কোনও মুহূর্তে গাছের গুঁড়িতে কিংবা কোনও খুঁটিতে লেগে ছাতু হয়ে যেতে পারে মাথাটা।
ডান চোখ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাঁ চোখ মেলে রানা দেখল পার্টিশনের ওধারের কামরা থেকে ডাল তোলার চামচের মত দেখতে কিন্তু আয়তনে দশগুণ বড় একটা চামচ বের হলো। চামচের ওপর সোহেলের সেই প্লাস্টিকের বল একখানা। চামচের হাতলটা বড় হতে হতে বারো-চোদ্দ ফুট লম্বা হলো। একটা সবুজ ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাবার সময় আলগোছে সেটা নামিয়ে দেয়া হলো চামচ থেকে। হাতল আবার ছোট হতে হতে অদৃশ্য হয়ে গেল কামরার ভিতর।
তা হলে এই শুভেচ্ছা নিয়েই এসেছে এবারের সাংস্কৃতিক মিশন? আর এই জন্যেই রেলপথে চলছে ওরা? গোটা পূর্ব-পাকিস্তানের সীমান্ত বরাবর এই বোমা ছড়িয়ে যাচ্ছে ওরা সবার অলক্ষ্যে। কিন্তু কী ওদের উদ্দেশ্য? এই টাইম-বম্ব ফাটলে পরে কী হবে? কোন সর্বনাশ ঘনিয়ে আসছে আমাদের দেশের ওপর কে জানে। ভেড়ামারাতে পৌঁছেই রিপোর্ট লিখতে হবে। ঈশ্বরদিতে নঈমকে দিয়ে দেবে রিপোর্ট এবং স্যাম্পল।
‘টাশশ!’ একটা তীক্ষ্ণ শব্দ কানে এল রানার ট্রেনের শব্দ ছাপিয়ে। চমকে উঠল ও। অনুভব করল, কানের পাশ দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল বুলেট। পা দুটো ভাঁজ করে ফেলল রানা, তারপর দড়ি বেয়ে দ্রুত উঠে আসতে থাকল। আবার সেই তীক্ষ্ণ শব্দটা এল কানে… ‘টাশশ’! এবারও লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো গুলি। কামরার ভিতর চলে এল রানা।
বাথরুম থেকে চোখ-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে বেরিয়ে এল মাসুদ রানা। জানালার ধারে বসে চেয়ে রইল বাইরের দিকে। বাসি মুখে সিগারেট বিস্বাদ লাগছে। আকাশটা লাল করে দিয়ে তখন সূর্য উঠছে পুব দিগন্তে। আঁধার পালিয়ে যাচ্ছে সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমে।