২৮ আগস্ট, ১৯৬৫।

মোখলেস এসে খবর দিল ট্যাক্সি এসে গেছে। অর্থাৎ, এবার দয়া করে গাত্রোত্থান করুন।

‘তুই আমার সুটকেসটা তুলে দে তো গাড়ির পিছনে,’ বলল রানা।

‘দিয়েছি, স্যর।’

‘তবে যা ভাগ এখান থেকে। চা খেয়ে নিই—দাঁড়াতে বল্ ড্রাইভারকে।’

রানাকে দেখেই লাফিয়ে ট্যাক্সির ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে এল ড্রাইভার। বেঁটে-খাটো হাসি-খুশি চেহারার লোকটা। ঢিলা খাকি কোর্তার বুক পকেট দুটো ফুলে আছে রুমাল, লাইসেন্স, টাকা-পয়সা, কিংস্টর্ক সিগারেটের প্যাকেট, দিয়াশলাই, চিরুনি আর হরেক রকম হাবিজাবি কাগজে। ময়লা পাজামার ততধিক ময়লা ফিতে ঝুলছে হাঁটুর কাছে। পায়ে প্রচুর ঝড়ঝাঁপটাতেও টিকে থাকা একটা থ্যাবড়া নাকের লেস-হীন জুতো। বয়স চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে হবে। সামনের দিকে একটা দাঁত নেই–সেই ফাঁকের মধ্যে একটা খেলাল ধরা। মিলিটারি কায়দায় ঝটাং করে এক স্যালিউট লাগিয়ে দিল সে রানাকে দেখে আনন্দের আতিশয্যে। থুক করে মুখ থেকে খেলালটা ফেলে দিয়ে ফোকলা হাসি হাসল।

‘আরে, হুজুর, আপনে! আপনেরে বিচরাইতে বিচরাইতে তো এক্কেরে পেরেসান হইয়া গেছি গা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখল সে রানাকে। ‘আমি দিলে ভাবি, মানুষটা গেল কই? এক্কেরে গায়েব হইয়া গেল গা! ইমুন সাংগাতি পাওলানটারে হালায় এখি বস্কিং মাইরা রাবিস বানাইয়া ফালাইল! হিকমতটা কি—আরিব্বাপরে বাপ!’

রানাকে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার বলল, ‘আরে উইঠা পরেন, হুজুর; খামোস খায়া খারোইয়া রইলেন কেলেগা?’

এমন বিচিত্র ভাব সংমিশ্রিত আকস্মিক অভ্যর্থনায় অবাক হয়ে গিয়েছিল রানা। ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠে বসল সে। তারপরই মনে পড়ল সেই ঘটনার কথা। মাস ছয়েক আগে রাত প্রায় এগারোটার দিকে সাভার আর নয়ারহাটের মাঝামাঝি জায়গায় জঙ্গলের ধারে এর গাড়ি আটক করেছিল একদল দুবৃত্ত। রানা আসছিল মানিকগঞ্জ থেকে। দূর থেকেই ব্যাপারটা আঁচ করে হেড লাইট অফ করে গিয়ার নিউট্রাল করে নিঃশব্দে একেবারে কাছাকাছি এসে থেমেছিল রানা। প্রাণভয়ে থর থর করে কাঁপছিল আর ভেউ ভেউ করে কাঁদছিল ড্রাইভার। ছোরা মারার ঠিক আগের মুহূর্তে যমদূতের মত এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রানা সর্দারের উপর। বেশ মারপিটও হয়েছিল। বেগতিক দেখে পালিয়েছিল দুবৃত্তরা। প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল (কী যেন নাম বলেছিল…ও, হ্যাঁ) ইদু মিঞার। সেই কৃতজ্ঞতা এই খাস ঢাকাইয়া কুট্টির মনে যে এমন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে ভাবতেও পারেনি রানা।

‘কেমন আছ, ইদু মিঞা?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘যিমুন দোয়া করছেন, হুজুর।’ বলেই স্টার্ট দিল ইদু মিঞা গাড়িতে। ফাস্ট গিয়ারে দিয়ে ক্লাচটা ছাড়ার কায়দা দেখেই বুঝল রানা, পাখোয়াজ ড্রাইভার।

হঠাৎ চোখ পড়ল রানার দরজায় দাঁড়ানো রাঙার মার উপর। মুখের দিকে চেয়েই বুঝল রানা, অনর্গল দোয়া দরুদ পড়ছে বুড়ি। গতরাতে জিনিসপত্র গোছগাছ করা দেখেই কয়েক রাকাত নামাজ বেড়ে গেছে বুড়ির। সাধে আর মোখলেস ওকে রানার মা বলে খেপায় না। কোথায় যেন ওর মৃত মায়ের সাথে মিল আছে এই স্নেহময়ী বৃদ্ধার। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়তে যাচ্ছিল, সচেতন হয়ে সামলে নিল রানা।

‘রাতের বেলা আর সাভারের দিকে যাও না তো, ইদু মিঞা?’

‘তোবা, তোবা। এই জিন্দেগীর মোদে তো আর না। আইজ ষোলো বচ্ছর ডাইবোরি করতাছি, হুজুর, যাই নাইক্কা। আর উই দিনকা যে কী অইলো-হালায়। এউগা পাসিঞ্জার, আমাগো মাহাল্লারই কণ্টেকদার…’ হঠাৎ থেমে গিয়ে কণ্ঠস্বর নামিয়ে ইদু মিঞা বলল, ‘আপনের পিছে আই. বি. লাগছে, হুজুর!’

‘কী করে বুঝলে?’ ঘাড় না ফিরিয়েই জিজ্ঞেস করল রানা।

‘এউগা মার্সিডিচ আইতাছে পিছে পিছে। পুরানা পল্টন থেইকা লাগছে পিছে! খারোন সাব, টাইম তো আছে, সিজিল কইরা দেই হালারে।’

হেয়ার রোড দিয়ে বেরিয়ে সাকুরার সামনে উঠে ডান দিকে না গিয়ে বাঁয়ে চলল ইদু মিঞা। রেডিয়ো পাকিস্তান ছাড়িয়ে রিয়ার-ভিউ মিররের দিকে চেয়ে বলল, ‘আইতাছে।’

শাহবাগের ঝর্ণাটা চট করে ঘুরেই আবার এয়ারপোর্টের দিকে চলতে থাকল ট্যাক্সি।

‘চেহারাটা দেইখা রাখেন, হুজুর।’

‘ওয়ান-ওয়ে রোড। আত্মগোপন করবার উপায় নেই। কালো মার্সিডিস বেঞ্জের ড্রাইভিং সিটে গোঁফদাড়ি পরিষ্কার করে কামানো সানগ্লাস পরা একজন ফর্সা লোক সোজা সামনের দিকে চেয়ে বসে আছে। এক নজরেই রানা বুঝল লোকটা ভারতীয় গুপ্তচর।’

যখন সত্যি সত্যিই পিছনের গাড়িটাও ঝর্ণা ঘুরে এয়ারপোর্ট রোড ধরল তখন দ্রুত একটা বালি ভরা ট্রাককে ওভারটেক করে পেট্রল পাম্প ছাড়িয়ে হাতীরপুলের দিকে মোড় নিল ইদু মিঞা। পাওয়ার হাউসের পাশ দিয়ে যেতে বাতাসে ভেসে আসা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণায় সামনের উইণ্ড-স্ক্রিন ঝাপসা হয়ে গেল। ওয়াইপারটা চালু করে দিয়ে প্রায় এক লাফে পার হয়ে গেল পুলটা ইদু মিঞার ট্যাক্সি। পুল থেকে নেমেই ডানদিকে মোড় ঘুরে নানান গলি ঘুচি পেরিয়ে গ্রীন রোডে গিয়ে পড়ল এবার ওরা। তারপর ওখান থেকে সোজা এয়ারপোর্ট।

ফার্মগেটের কাছে এসেই গাড়ি থামিয়ে মিটার ডাউন করে নিল ইদু মিঞা যাতে এয়ারপোর্ট থেকে যে নতুন প্যাসেঞ্জার উঠবে তার ঘাড়ে কিছু পয়সা আগে থেকেই উঠে থাকে।

এয়ারপোর্টে পৌঁছেই রানা দেখল কালো মার্সিডিস বেঞ্জটা নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে আছে NO PARKING লেখা একটা সাইন বোর্ডের নিচে। এত চালাকি খাটল না দেখে ইদু মিঞার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চাপা গলায় বলল, ‘হুজুর, নামলেই অ্যারেস করব আপনেরে। অখনও টাইম আছে। কন তো ভাইগা যাই গা।’

মনে মনে হাসল রানা। ইদু মিঞা তাকে হয় ক্রিমিনাল, নয় তো কমিউনিস্ট ঠাউরে নিয়েছে। মুখে বলল, ‘না, তার দরকার নেই। ভাল গাড়ি চালাও তুমি, ইদু মিঞা।’

দু’জন পোর্টার এসে রানার সুটকেস নিয়ে গেল ওজন করে ট্যাগ লাগাতে। দুটো দশ টাকার নোট বের করে ইদু মিঞার দিকে বাড়িয়ে দিল রানা। আধ হাত জিভ বের করে কয়েকবার মাথা নাড়াল ইদু মিঞা এপাশ-ওপাশ।

‘ট্যাকা দিয়া আমার ইজ্জতটা পাংচার কইরেন না, হুজুর। এর থেইকা দুইটা জুতার বারি মাইরা যান গা।’ আহত অভিমান ওর কণ্ঠে।

এই সূক্ষ্ম মান-অপমান জ্ঞান সম্পন্ন ঢাকাইয়া কুট্টিকে আর বেশি না ঘটিয়ে ব্রিফিং কাউন্টারের দিকে এগোল রানা। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বাঁ দিকের টেলিফোন বুথের দরজাটা ফাঁক করে দেখল সেই সানগ্লাস পরা শ্ৰীমান ডায়াল ঘোরাচ্ছে সেখানে দাঁড়িয়ে মাল ওজন করিয়ে আইডেন্টিফিকেশন ট্যাগ এবং টিকেট দেখিয়ে সরু বোর্ডিং পাস নিল রানা।

‘অ্যাটেনশন, ইওর অ্যাটেনশন প্লিজ। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স অ্যানাউন্সেস দ্য ডিপারচার অভ ইটস ফ্লাইট পি-কে ফাইভ টোয়েনটি-ওয়ান টু ঈশ্বরদি। প্যাসেঞ্জারস অন বোর্ড প্লিজ। থ্যাঙ্ক ইয়ু।’

খনখনে মেয়েলী কণ্ঠস্বর।

প্লেনে উঠে একটা চেনা মুখও দেখতে পেল না রানা। খুশিই হলো মনে মনে। মাঝামাঝি জায়গায় জানালার ধারে বসে সিট বেল্ট বেঁধে নিল ও, তারপর খুলল রাহাত খানের দেয়া কাগজটা। শুধু একটা লাইন লেখা:

DON’T HESITATE TO KILL.

আকাশে উঠে গেল ফকার-ফ্রেণ্ডশিপ। হলুদ রোদ বিছিয়ে পড়েছে অনেক নীচে সবুজ মাঠের ওপর।

ছোট্ট শহর কুষ্টিয়া। রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই শোচনীয়। তৈরির পর মিউনিসিপ্যালিটি বোধহয় মানুষকে টিকা দিয়েই আর ফুরসত পাচ্ছে না—রাস্তার গায়ে যে স্থায়ী বসন্তের দাগ পড়ে গেছে, সেদিকে লক্ষ্যই নেই। যানবাহনের মধ্যে রিকশাই একমাত্র ভরসা।

খোলা অবস্থায় চললে নির্ঘাত ছিঁটকে পড়বে রাস্তার ওপর, তাই হুড তুলে দিয়ে চাদিতে খটাং খটাং বাড়ি খেতে খেতে চলল রানা রিকশায় চেপে।

ডাকবাংলোতে সৌভাগ্যক্রমে একখানা ঘর খালি ছিল, পেয়ে গেল রানা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল অন্যান্য ঘরগুলোতে বিশ্রাম নিচ্ছে সকালের ট্রেনে যশোর থেকে আসা কলকাতার সাংস্কৃতিক মিশনের শিল্পীবৃন্দ।

স্নান করে খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নেবে মনে করে সুটকেস থেকে কাপড়, টাওয়েল আর সাবান বের করে নিয়ে অ্যাটাচড বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে দেখল রানা দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। একটু ধাক্কাধাক্কি করে বুঝল ভিতর থেকে ছিটকিনি লাগানো। মিনিট পাঁচেক পরে খুট করে বল্টু খোলার শব্দ পাওয়া গেল। আরও দু’মিনিট পার হয়ে গেলেও যখন কেউ বেরিয়ে এল না, তখন ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মৃদু হেসে রানা গিয়ে ঢুকল বাথরুমে। ওটা পাশাপাশি দুটো ঘরের। কমন বাথরুম। পাশের ঘরের ভদ্রলোক কাজ সেরে এদিকের বন্টু খুলে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেছেন।

মিনিট দশেক শাওয়ারের ঠাণ্ডা পানিতে স্নান করে সন্তুষ্ট মাসুদ রানা গুনগুন করতে করতে বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে, ওদিকের বল্টুটা খুলে দেয়ার কথা বেমালুম ভুলে গেছে।

ঠিক বিকেল পাঁচটায় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল রানার। দরজা খুলেই দেখল, বিশ-বাইশ বছর বয়সের অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। মুখে এক-ফোঁটা মেক-আপ নেই, শুধু কপালে একটা লাল কুমকুমের টিপ। খোলা এলোচুল। চোখ দুটো একটু ফোলা—এই মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে মনে হচ্ছে। পরনে হালকা নীল অর্গাণ্ডির ওপর সাদা ছাপ দেয়া সাধারণ শাড়ি। সাংস্কৃতিক মিশনের কোনও শিল্পী হবে হয়ত। চোখ দুটো ঝলসে যাবার যোগাড় হলো রানার—মেয়েটির একই অঙ্গে এত রূপ দেখে।

‘ভেতরে আসুন,’ বলল রানা।

‘আপনাকে বিরক্ত করতে হলো বলে আমি দুঃখিত।’ পরিষ্কার বাংলায় বলল মেয়েটি। কথা ক’টা যেন নিক্তি দিয়ে ওজন করা। একটু ফাঁসফেঁসে মেয়েটির কণ্ঠস্বর। যেন বেশ কিছুটা বাধা পেরিয়ে বেরোচ্ছে শব্দ। কিন্তু তীক্ষ্ণ অদ্ভুত একটা মাদকতা আছে সে স্বরে। ঘরের ভিতরে প্রবেশ করবার কিছুমাত্র আগ্রহ দেখা গেল না তার। চোখে মুখে বিরক্তির স্পষ্ট ছাপ।

এক সেকেণ্ডে রানার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। ও বলল, ‘আর আপনাকে দুঃখিত অবস্থায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমে আমি বিস্মিত, তারপর চিন্তিত এবং সবশেষে একান্ত লজ্জিত। এক্ষুণি আমি বল্টু খুলে দিচ্ছি বাথরুমের। আর এই জোড়হাত করে মাফ চাইছি–জীবনে কোনদিন আর এমন কাজ করব না।’

হেসে ফেলল মেয়েটি। রানার ভণ্ডামি দেখে রাগ জল হয়ে গেছে তার।

‘বেশ লোক তো আপনি! ইচ্ছে করেই ছিটকিনি লাগিয়ে রেখেছিলেন নাকি?’

‘না। সত্যি বলছি, ভুলে। ছি ছি ছি, দেখুন তো, আপনাকে কত অসুবিধের মধ্যে ফেললাম! আন্তরিক লজ্জিত হলো রানা।’

‘আপনি কী করে বুঝলেন আমি পাশের ঘরেই আছি এবং এই কারণেই এসেছি?’

‘দেখুন, আমি নিতান্ত শান্তিপ্রিয় নিরীহ মানুষ। তবে ভয় পেলে কেন জানি আমার বুদ্ধি খুলে যায়। আপনার অমন মারমুখো মূর্তি দেখেই ভড়কে গিয়ে আমার মাথাটা খুলে গিয়েছিল। আর তা ছাড়া…’

‘মিত্রা!’ একটা ভয়ানক গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

চমকে উঠে রানা চেয়ে দেখল একজন লোক এগিয়ে আসছে বারান্দা ধরে। সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা। বয়েস চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে—ঠিক কত বোঝা যায় না। পরনে শান্তিপুরী ধুতি আর খদ্দরের পাঞ্জাবী—কালো জহর কোট চাপানো তার ওপর। পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি, আর সারাটা মাথা জুড়ে চকচকে টাক। অদ্ভুত ফর্সা গায়ের রঙ। বড় বড় কানের ফুটো। দেহের সঙ্গে বেমানান প্রকাণ্ড গোল মাথাটা কাঁধের ওপর চেপে বসে আছে—ঘাড়ের চিহ্নমাত্র নেই। আরেকটু কাছে আসতেই রানা লক্ষ্য করল পূর্ণিমার চাঁদের সমান গোল মুখটায় দাড়ি, গোঁফ, ভুরু, কিছু নেই—বোধহয় কোনদিন ওঠেইনি; কিংবা ঝরে পড়েছে Alopecia totalis রোগে। ছোট ছোট লম্বাটে হলুদ মঙ্গোলিয়ান চোখ দুটো নিপ্রভ, অভিব্যক্তিহীন। লালচে পুরু ঠোঁট দুটো ঘেন্না ধরায়। মুখের দুই কোণে আবার ঘায়ের চিহ্ন। সবটা মিলিয়ে অদ্ভুত রকমের বিশ্রী চেহারা লোকটার। এক নজরেই অপছন্দ করল রানা লোকটাকে। লোকটার চারপাশে একটা অশুভ ছায়া দেখতে পেল সে। বিপদ, ভয় আর অমঙ্গলের প্রতীক যেন লোকটা।

জিভ দিয়ে বাঁ দিকের ঘা-টা ভিজিয়ে নিয়ে মিত্রার দিকে চেয়ে সে বলল, ‘এখানে কী করছ মিত্রা, ঘরে যাও।’

বিনা বাক্যব্যয়ে মাথা নিচু করে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল মিত্রা। এবার রানার ওপর চোখ পড়ল লোকটির। ভয়ঙ্কর হলুদ দৃষ্টি মেলে পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সে রানাকে। সাপের মত পলকহীন সে দৃষ্টি। অস্বস্তি বোধ করল রানা সেই ঠাণ্ডা দৃষ্টির সামনে। সাধারণ ভদ্রতার খাতিরে রানা বলল, ‘আমার নাম…’

‘তরিকুল ইসলাম। এপিপি-র ফটোগ্রাফার।’ রানার বক্তব্য নিজেই বলে দিল লোকটা। ‘আর আমার নাম জয়দ্রথ। জয়দ্রথ মৈত্র। এই শুভেচ্ছা মিশনের অধিকারী। পরে ভাল করে আলাপ হবে, মি. ইসলাম-এখন আমি একটু ব্যস্ত।’

ডান দিকের ঘা-টা চেটে নিয়ে ধীর পায়ে চলে গেল জয়দ্রথ মৈত্র। রানাও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। এতক্ষণ যেন ভূতে ভর করেছিল ওর ওপর।

বাথরুমের দরজাটা খুলে দিয়ে একটা ইজি চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর পা তুলে দিল রানা। তারপর একটা সিনিয়র সার্ভিস ধরিয়ে চোখ বুজে মারল কষে লম্বা টান। জয়দ্রথ মৈত্রের চেহারাটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। তা হলে এই হচ্ছে ইণ্ডিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের সেই ভয়ঙ্কর H-যার সঙ্গে সংঘর্ষে বহু পাকিস্তানী দুঃসাহসী সিক্রেট এজেন্ট নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অথচ একটি আঁচড়ও পড়েনি এর গায়ে। অদ্ভুত বুদ্ধিমান এবং কৌশলী এই H সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মেজর জেনারেল রাহাত খান পর্যন্ত সমীহ প্রকাশ না করে পারেন না। দুর্দান্ত এই ভয়ঙ্কর লোকটির পাশে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেকে বড় ক্ষুদ্র মনে হলো রানার। মাথা ঝাঁকিয়ে এই ভাবটা দূর করবার চেষ্টা করল মাসুদ রানা। মিত্রার কথা ভাবতে চেষ্টা করল। এই মেয়েটিকে কী শুধুই শিল্পী হিসেবে এনেছে, নাকি এ-ও স্পাই? গানের শিল্পী, না নাচের? নাকি চেহারা ভাল বলে ধরে এনেছে-কোরাস গাইবে? অথবা অ্যানাউন্সারও হতে পারে। পুরো নামটা কী মেয়েটার? মিত্রা চৌধুরী? মিত্রা ব্যানার্জী? মিত্রা সেন গুপ্তা বা ঠাকুরতা? কিংবা নাগ, ভৌমিক, রায়, চক্রবর্তী, মুখোপাধ্যায়…

হঠাৎ একটু খুট আওয়াজ হতেই চোখ মেলে রানা চেয়ে দেখল হাসছে সোহেলের উজ্জ্বল দুই চোখ। এতদিন পর রানাকে পেয়ে আনন্দে উদ্ভাসিত। কাঁধে একটা দেড় টাকা দামের ছোট্ট টাওয়েল। বয়-বেয়ারার সাদা ড্রেস পরা। কোমরের বেল্টে পিতলের মনোগ্রামে লেখা KUSHTIA REST HOUSE.

‘কী নাম হে তোমার, ছোকরা?’ খুব ভারিক্কি চালে জিজ্ঞেস করল রানা।

দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট চেপে ধরে চোখ পাকিয়ে প্রথমে ঘুসি দেখাল সোহেল, তারপর বিনয়-বিগলিত কণ্ঠে বলল, ‘আজ্ঞে, রাখাল দাশ। চার নম্বর বলেও ডাকতে পারেন।’ বুকে আঁটা নম্বর দেখাল সে।

‘বেশ, বেশ। ঘরটায় চট করে ঝাড় লাগিয়ে দাও তো, বাবা রাখাল। বড় নোংরা হয়ে আছে।’ চোখ টিপল রানা; ভাবটা—কেমন জব্দ!

সোহেল দেখল ওকে বেকায়দা অবস্থায় পেয়ে খুব এক হাত নিচ্ছে রানা। হেসে ফেলল সে। বলল, ‘আজ্ঞে, এখন ঝাঁট দিলে ধুলোয় টিকতে পারবেন না। আপনি বাইরে যাবার সময় চাবিটা দিয়ে যাবেন, পরিষ্কার করে দেব সব নোংরা।’

‘তাই দিও। এখন চা-টা কী খাওয়াবে খাওয়াও দেখি জলদি। সন্ধের দিকে একটু বাইরে যাব ঘণ্টা খানেকের জন্যে।’

ইঙ্গিতটা বুঝল সোহেল। বাইরে মানে সোহেলের বাংলো। হেড-অফিসের সঙ্গে কথা আছে বোধহয়। নীরবে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে।

হাঁটার সময় সোহেলের ডান হাতটা দুলছে, বাঁ হাতটা স্থির হয়ে রয়েছে দেখে খচ্‌ করে তীব্র একটা বেদনার খেচা বিঁধল রানার বুকে। একসময় রাহাত খানের সবচাইতে প্রিয়পাত্র ছিল ওরা দুজন। বক্সিং, যুযুৎসু, পিস্তল ছোঁড়া, শক্তি, বুদ্ধি, সাহস, সব ব্যাপারেই দুজন কেউ কারও চেয়ে কম যেত না। নিজেদের মধ্যে যেমন ছিল ওদের তীব্র প্রতিযোগিতা, তেমনি ছিল গভীর বন্ধুত্ব। কিন্তু ভাগ্য সোহেলের উপর বিরূপ। একবার একটা অ্যাসাইনমেন্ট-এ চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে পাথরে পা পিছলে টাল সামলাতে না পেরে চাকার তলায় কাটা পড়ল বাম হাত। একেবারে ছাটাই না করে বিপজ্জনক কাজ থেকে সরিয়ে ওকে যশোর-কুষ্টিয়া ব্রাঞ্চের হেড করে দিয়েছেন রাহাত খান। কে জানে, হয়তো একদিন রানারও এমনি অবস্থা হবে। নিজের অজান্তেই ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রানার বুক চিরে।

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ট্রে-তে করে এক পট চা আর কিছু বিস্কিট নিয়ে ফিরে এল সোহেল। রানার পাশে টিপয়টা টেনে দিয়ে সেগুলো নামিয়ে রাখতে রাখতে চাপা গলায় বলল, ‘তোকে চিনে ফেলেছে ওরা, রানা! আমার যদ্দূর বিশ্বাস জেনে গেছে ওরা তোর পরিচয়। জয়দ্রথ মৈত্রের কাছ থেকে এক টুকরো কাগজ নিয়ে ওদের দলের একজন প্রত্যেক ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাইকে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে খুব সম্ভব। আমি এখনও ওদের সন্দেহের বাইরে আছি। হিন্দু বলে বিশেষ ফেভারও পাচ্ছি।’ একটা চাবি বের করল সোহেল পকেট থেকে। ‘এই নে, আমার ওয়ায়ারলেস রুমের চাবি। আমি সন্ধের সময় বেরোতে পারব না। তুই সোজা রেলস্টেশনে চলে যাবি। ওখান থেকে আমার লোক তোকে নিয়ে যাবে বাড়িতে। রাতে আমি নজর রাখব, আর হঠাৎ যদি দরকার মনে করিস, এই বেল টিপে দিস। আজই সকালে লাগিয়েছি।’ খাটের পায়ায় লাগানো গোপন কলিংবেলের সুইচ দেখিয়ে দিল সোহেল।

‘বেশ জমিয়ে নিয়েছিস দেখছি, দোস্ত!’ সপ্রশংস দৃষ্টিতে চাইল রানা ওর দিকে। কিন্তু সেই সঙ্গে জুড়ে দিল, ‘দেখিস, ভুলে যাস না আবার, আমি বেরিয়ে গেলেই ঘরটায় একহাত ঝাড়ু লাগিয়ে দিস, বাবা!’ চোখে-মুখে দুষ্টামির হাসি রানার।

‘যা-যাহ, বাজে বকিস না। ফাই-ফরমাশ খাটতে খাটতে জান বেরিয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে। পিঠটা বাকা হয়ে গেছে আমার। ঘর ঝাড়ু দেব না, শালা। বেঁটিয়ে তোর বিষ ঝেড়ে দেব।’

বেরিয়ে গেল সোহেল। আবার রানার চোখে পড়ল, বাম হাতটা স্থির হয়ে ঝুলছে সোহেলের। কিন্তু দমে যায়নি মানুষটা। তেমনি হাসি খুশি চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল দুই চোখ। হার মানেনি ও ভাগ্যের কাছে।

রাতে মিত্রা সেন সত্যিই মুগ্ধ করল রানাকে। নৃত্যকলাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকৃতি দিল ও এই প্রথম। কিন্তু নাচের শেষে অকুণ্ঠ প্রশংসা করতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হলো রানাকে। পরিষ্কার ঘৃণা প্রকাশ পেল মিত্রার ব্যবহারে। আহত রানা বুঝল, সত্যিই ধরা পড়ে গেছে ও। ঢাকা এয়ারপোর্টের সেই সানগ্লাস পরা ছোকরাকে অবজ্ঞা করা তার উচিত হয়নি।