২৭ আগস্ট, ১৯৬৫।

মতিঝিল কমার্শিয়াল এরিয়ায় ছয়তলার উপর একটা কার্পেট বিছানো ঘরের পশ্চিমমুখী জানালাটা খোলা। পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এজেন্ট মাসুদ রানা সে-জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আনমনে স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসের দিকে চেয়ে রয়েছে। অসম্ভব বৃষ্টি হওয়ায় মাঠে পানি জমে আজ বিকেলের ফুটবল খেলা বাতিল হয়ে গেছে। পতাকা নামিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বেশ কিছুক্ষণ হয় বৃষ্টি থেমেছে। পশ্চিম আকাশের সাদা মেঘের গায়ে এখন নানা রঙের খেলা। সারি সারি দর্শকদের গ্যালারি একেবারে ফাঁকা। দুটো ছাগল, বোধহয় দারোয়ানের হবে, নিশ্চিন্ত মনে চরছে মাঠে। পাশে সুইমিং পুলের টলটলে পরিষ্কার জলে আঁটসাঁট কস্টিউম পরে সাঁতার প্র্যাকটিস করছে কয়েকটা উন্নতস্তনা, অ্যাংলো তরুণী। বায়তুল মোকাররমের গম্বুজের উপর চোখ পড়ল এবার রানার। তারপর সিঁড়িতে। কয়েকজন মুসল্লি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে মগরেবের আজান শুনে। প্রকাণ্ড জিপিও বিল্ডিংটা গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ডেড লেটার-এর বোঝা বুকে নিয়ে। আরও অনেক দূরে রেসকোর্সের শিব মন্দিরের চুড়ো দেখা যাচ্ছে আবছা। ঢাকা নগরীর বুকে সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে।

হঠাৎ একটা সাইলেন্সর পাইপ ভাঙা বেবি ট্যাক্সি এমন বেয়াড়া শব্দ করে সামনের রাস্তা দিয়ে চলে গেল যে রানার বিরক্ত দৃষ্টি এইসব সুন্দর দৃশ্য ছেড়ে ফিরে এল কালো পিচ ঢালা ভেজা রাস্তাটার উপর। সাইড লাইট জ্বেলে মৃদু গুঞ্জন তুলে হরেক রঙের সুন্দর সুন্দর স্যালুন, সেডান চলে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে ছবির মত। অপেক্ষা করছে রানা।

‘এক কাপ কফি দেব?’ ঠিক কানের পাশে মোলায়েম নারী কণ্ঠের এই প্রশ্নে চমকে উঠল রানা। দেখল নব-নিযুক্ত সুন্দরী স্টেনো-টাইপিস্ট মিস নাসরীন রেহানা তার একান্ত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। রানার কাজের সুবিধার জন্যে ওকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়েছে হপ্তাখানেক হলো। চোখে চোখ রেখে রানা বুঝল মেয়েটি নীরবে বলছে, ‘আশপাশে কেউ নেই, ইচ্ছে করলেই সুযোগ গ্রহণ করতে পারো, আমি আপত্তি করব না।’

‘কী বলছ?’ ইঙ্গিত না বোঝার ভান করল রানা।

‘কফি?’ রেহানার চোখে স্পষ্ট আমন্ত্রণ। ঠোঁটে বাঁকা হাসি। লিপস্টিকে লাল ঠোঁট দুটোর ফাঁক দিয়ে চকচকে সাদা দাঁত দেখা যাচ্ছে অল্প একটু। আর একটু কাছে সরে এল সে। ভ্যাসলিনের গন্ধ ওর চুলে, মুখে পুরু প্রসাধনের প্রলেপ। ওড়নাটা একপাশে সরে যাওয়াতে গভীর খাদ দেখা যাচ্ছে বুকের মাঝামাঝি।

মনে মনে বিরক্ত হয়ে আবার জানালার বাইরে চোখ ফেরাল রানা। এরা তাকে কী মনে করে? তাদের ইঙ্গিত প্রত্যাশায় উন্মুখভাবে অপেক্ষমাণ বানর বিশেষ? ইশারা পেলেই ধন্য হয়ে গিয়ে নাচতে আরম্ভ করে দেবে? নারীসঙ্গ কামনা ছাড়া পুরুষের অন্য ভাবনা থাকতে পারে না আর?

‘বাতিটা জ্বেলে দাও রেহানা। আর হ্যাঁ, কফি এক কাপ দিতে পারো। তার আগে এক দৌড়ে U সেকশন থেকে একটা ফাইল নিয়ে এসো। ফোনে পারটিকুলাস দিয়ে দিয়েছি, মিসেস চৌধুরীর কাছে চাইলেই পাবে। কুইক।’

‘রাইট, স্যর,’ আহত আত্মাভিমান প্রকাশ পেল মেয়েটির কণ্ঠস্বরে। লাইট জ্বেলে দিয়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে।

মেয়েটিকে এমন বিশ্রী ভাবে প্রত্যাখ্যান করে দুঃখ হলো রানার। কী করবে বেচারি। পুরুষ বস-কে সন্তুষ্ট রাখবার একটা পথই জানা আছে তার। পৃথিবীর সবাইকে যেমন দেখেছে, রানাকেও ঠিক তেমনি মনে করে একই উপায়ে খুশি করতে চেয়েছিল। ভাল মাইনের লোভনীয় চাকরিটার নিরাপত্তা নির্ভর করে রানার ব্যক্তিগত সন্তুষ্টির উপর—এটা বুঝে নিয়ে ঋণী করে রাখতে চেয়েছিল ওকে।

রানা কিছু ভালমানুষ নয়, অনেক দোষত্রুটি আছে ওর চরিত্রে। কিন্তু ও জয় করে নিতেই অভ্যস্ত—চাকরি ভয়ে ভীতা একটি মেয়েকে বাগে পেয়ে সুযোগ গ্রহণ করতে নয়।

ফাইলটা দেখেই চমকে উঠল রানা। তা হলে এই ব্যাপার। আবার সেই ইণ্ডিয়া? অল্প কিছুক্ষণ আগে মেজর জেনারেল রাহাত খানের আদেশ এসেছিল ইন্টারকমে — রানা, U সেকশন থেকে IE/VII/65 ফাইলটা আনিয়ে পড়ে ফেল। লিখে নাও— IF/VII/65। আমি একটু ডিফেন্স সেক্রেটারির অফিসে যাচ্ছি। অল্পক্ষণেই ফিরব। তুমি অফিসেই থেকো—কথা আছে।

তখনই বুঝেছিল রানা, বুড়োর মাথায় কোনও নতুন পোকা ঢুকেছে। ফাইলটা দেখেই বুঝতে পারল আর একটা অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি হচ্ছে ওর জন্য। আবার শক্তি পরীক্ষায় নামতে হবে ওকে কোনও বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে। খুশি হয়ে উঠল রানার মন।

ফাইলের পাতায় ডুবে গিয়েছিল মাসুদ রানা। একটা সিগারেট ঠোঁটে লাগিয়ে সেটা ধরিয়ে নিতেও ভুলে গিয়েছিল। শেষ পাতাটা উল্টাতেই হঠাৎ খট করে একটা শব্দে চমকে উঠল রানা। দেখল ওর রনসন লাইটারের ছোট্ট চোয়ালটা হাঁ হয়ে আছে। রেহানার হাতে ধরা সেটা।

সিগারেট ধরিয়ে রানা বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’

‘ইউ আর ওয়েলকাম, স্যর। আপনার কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’

ফাইলটা বন্ধ করে কফির কাপে চুমুক দিল রানা। তারপর সপ্রশংস দৃষ্টিতে রেহানার দিকে চেয়ে বলল, ‘অপূর্ব হয়েছে তো কফিটা! বানিয়েছে কে?’

‘আমি।’

‘চমৎকার! কিন্তু তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে, রেহানা। ওই বুড়োকে (ছাতের দিকে চোখের ইঙ্গিত করল রানা) কোনদিন কফি খাওয়াতে পারবে না।’

‘কেন?’ সত্যিই বিস্মিত হলো রেহানা। ‘ওঁকে কফি খাওয়ালে কী হবে?’

‘এক কাপ কফি খেলেই বুড়ো তোমাকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিজের স্টেনো করে নেবে। আর ওই গোলাম সারওয়ার ভূতটা এসে পড়বে আমার ঘাড়ে।’

‘তা হলে ভালই হবে,’ হেসে ফেলল রেহানা। সহজ হতে পেরে বেঁচে গেল ও।

ঠিক এমনি সময়ে ইন্টারকমের মধ্য থেকে একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর যেন চাবুক মারল রানাকে।

‘ওপরে এসো, রানা। আর এইসব হালকা আলাপ করবার সময় ইন্টারকমের সুইচটা অফ করে দিও।’

জিভ কাটল রেহানা চোখ বড় বড় করে।

‘সরি, স্যর, এক্ষুণি আসছি, স্যর,’ বলেই অফ করে দিল রানা ইন্টারকমের সুইচ। যেন চুরি করে ধরা পড়েছে এমনি মুখের ভাব হলো।

নিজের টাইপ রাইটারের সামনে ফিরে গিয়ে মুখটা হাঁ করে নিঃশব্দে হাসছে। রেহানা রানার এই পর্যুদস্ত অবস্থায় আন্তরিক খুশি হয়ে। জোরে হাসতে সাহস হচ্ছিল না, পাছে রাহাত খান শুনে ফেলে। পিত্তি জ্বলে গেল রানার তাই দেখে।

ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ও রেহানার ডেস্কের সামনে। তারপর ধাই করে প্রচণ্ড এক কিল বসাল ডেস্কের উপর। আধ হাত লাফিয়ে উঠল টাইপ রাইটার।

‘হাসছ কেন? ফাজিল মেয়ে কোথাকার! এত হাসির কী আছে?’

রানার ছেলেমানুষি রাগ দেখে এবার উচ্চ কণ্ঠে হেসে উঠল রেহানা। তীব্র দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তার প্রতি কপট অগ্নিবর্ষণ করে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল রানা ঘর থেকে।

সাততলার উপর গোলাম সারওয়ারের কামরার মধ্যে দিয়ে গিয়ে মেজর জেনারেল রাহাত খানের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল রানা। হাতলে হাত দিয়ে, বরাবর যেমন হয়, হঠাৎ বুকের মধ্যে ছলাৎ করে উঠল এক ঝলক রক্ত। অন্যমনস্ক ভাবে গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ সামনে লোক পড়ে গেলে যেমন হয় তেমনি। ছুরির ফলার মত শান দেয়া ছিপছিপে লম্বা এই বুদ্ধিমান লোকটির তীক্ষ্ণদৃষ্টির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে ভাবলেই কেন জানি রানার বুকের ভিতরটা হিম হয়ে আসে। এই বৃদ্ধকে ও কতখানি ভালবাসে, কত ভক্তি করে তা ও জানে; কিন্তু এত ভয় যে কেন করে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।

মস্ত এয়ারকণ্ডিশণ্ড রুমে একটা দামি সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওধারে পিঠ উঁচু রিভলভিং চেয়ারে সোজা হয়ে বসে একটা প্যাডের উপর খস খস করে কী যেন লিখছেন রাহাত খান। চোখ না তুলেই বললেন, ‘বসো।’

একটা চেয়ারে বসে ঘরের চারধারে চেয়ে দেখল রানা। মাস চারেক আগে যেমন দেখেছিল, প্রায় তেমনি ছিমছাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আছে ঘরটা। বদলের মধ্যে এই, টেবিলের উপর কিং সাইজ চেস্টারফিল্ডের বদলে এক বাক্স কিউবার তৈরি হাভানা চুরুট। সপ্রতিভ অভিজাত চেহারায় এতটুকু পরিবর্তন নেই। তেমনি ধবধবে সাদা ঈজিপশিয়ান কটনের স্টিফ কলার শার্ট, সার্জের সুট আর বৃটিশ কায়দায় বাঁধা দামি টাই।

হংকং-এর ব্ল্যাক হক অ্যাসাইনমেন্ট-এ আমাদের সাফল্যে চাইনিজ গভর্নমেন্ট এতই সন্তুষ্ট হয়েছে যে পিসিআইকে কংগ্রাচুলেট করে বার্তা পাঠিয়েছে একটা। কিন্তু আমার ধারণা অতখানি রিস্ক নেয়া তোমার উচিত হয়নি। ডক্টর হকের পুরো রিপোর্ট আমি পড়ে দেখেছি। ছোরাটা আর এক ইঞ্চি বাম দিকে লাগলেই তোমার দুঃসাহসের ইতি হয়ে যেত। যাক, এখন বিষের ক্রিয়া আর নেই। এফ-সেকশন তোমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ বলে সাটিফাই করছে।

রানা কোনও কথা বলল না। বুঝল, এই কথাগুলোর মানে, এবার নতুন কাজের ভার নিতে হবে তোমাকে, প্রস্তুত হয়ে নাও। বাক্স থেকে একখানা সেলোফেন পেপার মোড়া সিগার বের করে সযত্নে কাগজ ছাড়িয়ে ধরিয়ে নিলেন রাহাত খান রানার উপহার দেয়া রনসন ভ্যারাফ্লেম গ্যাস লাইটার জ্বেলে। দামি তামাক পাতার কড়া গন্ধ এল নাকে।

‘U সেকশনের ওই ফাইলটা পড়েছ? কী লিখেছে ওতে?’

‘পড়েছি, স্যর। সাংস্কৃতিক মিশন এসেছে কলকাতা থেকে গত বাইশ তারিখে। নাচ-গান-বাজনার জন্য জনা পনেরো শিল্পী আর দশ বারোজন টেকনিশিয়ান এসেছে স্টেজ ডেকোরেশন, মাইক এবং লাইট কন্ট্রোলের জন্য। নামগুলো মনে নেই, স্যর। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করে বেড়াচ্ছে ওরা।’

‘ব্যস! এই? আর কিছু চোখে পড়েনি তোমার?’

‘আর একটা ব্যাপারে একটু খটকা লেগেছে, স্যর। ঢাকার পরেই চট্টগ্রাম যাওয়া উচিত ছিল ওদের। তা না গিয়ে ওরা গেছে খুলনায়। তারপর যশোর। ওদের প্রোগ্রাম দেখছি— খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী এবং দিনাজপুর। অর্থাৎ আগাগোড়া পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত বা পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব সীমান্ত ঘেঁষে। রাহাত খানের মুখের দিকে চেয়ে রানা দেখল একটা প্রশংসাসূচক সূক্ষ্ম হাসির রেখা। রানা তার দিকে চাইতেই মিলিয়ে গেল হাসিটা।

‘বেশ। এখন বলো দেখি অল ইণ্ডিয়া রেডিও যখন দৈনিক চার-পাঁচ ঘণ্টা চিৎকার করে পৃথিবীর কাছে নালিশ জানাচ্ছে আমরা কাশ্মীরে ইনফিলট্রেটর ঢুকিয়েছি, ছত্রী সেনা এবং স্যাবোটিয়ার পাঠিয়েছি শ্রীনগরে, কাশ্মীরে মুক্তি সংগ্রামীরা আসলে পাকিস্তানী সৈন্য ইত্যাদি, ইত্যাদি; ঠিক সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে সাংস্কৃতিক শুভেচ্ছা মিশন পাঠাবার পেছনে কী মহৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে? নিশ্চয়ই এদের কোনও বিশেষ মতলব বা স্বার্থ লুকানো আছে এর পেছনে, তাই না?’ পায়ের উপর পা তুলে একটু আরাম করে বসলেন রাহাত খান।

‘অসম্ভব নয়,’ উত্তর দিল রানা।

‘কী সেই স্বার্থ, তাই বের করতে হবে তোমাকে।’

‘আমাকে?’

‘হ্যাঁ। এ কাজের ভার ছিল আমাদের খুলনা এজেন্ট রহমানের ওপর। সে এদের সাথে আঠার মত লেগে গিয়েছিল। হয়তো কিছুদূর অগ্রসর হয়েছিল। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক আগে খবর এসেছে তাকে কেউ নির্মম ভাবে খুন করেছে। যশোর এয়ারপোর্টের কাছে একটা ঝোঁপের ধারে তার রক্তাক্ত মৃতদেহ পাওয়া গেছে।’

‘আমাদের রহমান! অবাক হয়ে গেল রানা। রহমানের প্রাণবন্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত চেহারাটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। কিন্তু আমাদের দেশে আমাদের লোক মেরে রেখে যাবে এ কেমন কথা!’

রানার চোখে সংকল্প দেখতে পেলেন রাহাত খান। কয়েক সেকেণ্ড সময় দিলেন ওকে সামলে নেয়ার জন্য। নিভে যাওয়া চুরুটটা ধরিয়ে নিলেন। তারপর আবার আরম্ভ করলেন, কাল দশটার ফ্লাইটে তুমি যাচ্ছ ঈশ্বরদি। টিকেট বুক করা হয়ে গেছে। ওখান থেকে ট্রেনে যাবে কুষ্টিয়ায়। তোমার নাম তরিকুল ইসলাম, এপিপি-র ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফার। আইডেন্টিটি কার্ড এবং অন্যান্য টুকিটাকি কয়েকটা জিনিস সকালে তোমার বাসায় পৌঁছে যাবে।’

‘ঠিক কী ধরনের কাজ হবে আমার, স্যর?’

‘ওদের গতিবিধির উপর নজর রাখবে। সোহেলকে পাবে ডাকবাংলোর বয় বেয়ারাদের মধ্যে। ও তোমাকে অনেক সাহায্য করতে পারবে। আমার যতদূর বিশ্বাস, একটা ভয়ানক প্ল্যান এঁটেছে ওরা এবার। আট-ঘাট বেঁধে নেমেছে ওরা। আমার অনুমান যদি সত্যি হয় তবে কত সাঙ্ঘাতিক আঘাত আসছে আমাদের দেশের উপর তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। ডিফেন্স সেক্রেটারি তো আমার অনুমান শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন। বেয়ারাকে ডেকে ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খাওয়াতে বললেন, আমাকে।’ বিরক্তিতে কাঁচা-পাকা, ভুরু জোড়া কুঁচকে গেল রাহাত খানের। কিন্তু তুমি তো আমাকে চেনো, রানা। আচ্ছা, আরেকটা জিনিস দেখাচ্ছি তোমাকে।’

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন রাহাত খান। তারপর কম্পিউটারের সামনে গিয়ে কয়েকটা বোতাম টিপে দিলেন। কয়েকটা বাতি জ্বলল নিভল, ঘড়র ঘড় শব্দ হলো ওর ভেতর থেকে। আধুনিকতম বিরাটকায় কম্পিউটার প্রয়োজনীয় তথ্য টাইপ করে দিল। কাগজটা ছিঁড়ে নিয়ে রানার হাতে দিয়ে রাহাত খান বললেন, ‘কলকাতা থেকে এই ইনফরমেশন এসেছে।’

রানা চোখ বুলাল কাগজটার উপর। তাতে লেখা:

Something serious cooking up in Titagarh called ‘Operation Goodwill’–the present Mission is connected with it, ‘H’ leading the group.

শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল রানার কথা কয়টা পড়ে।

‘ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারছ এবার?’ রানা মাথাটা কাত করলে আবার শুরু করলেন রাহাত খান। ‘‘H’ যেখানে দলপতি হয়ে এসেছে সেখানে রহমানকে দেয়া আমারই ভুল হয়ে গিয়েছিল। বিপদের জন্য আমাদের রহমানও প্রস্তুত ছিল—কিন্তু মৃত্যুর জন্যে কে কখন প্রস্তুত থাকে? একটু কোথাও ভুল করেছে—ব্যস…’

ডানহাতটা উপুড় করে রাখা ছিল টেবিলের উপর, তিন ইঞ্চি উপরে উঠিয়ে কব্জি থেকে সামনেটুকু ডান দিকে দ্রুত একবার ঝাঁকালেন রাহাত খান। অর্থাৎ—খতম।

‘কাজেই সাবধান। রহমানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেব আমরা। চুপচাপ হজম করব না। কিন্তু প্রথমে ওদের উদ্দেশ্য জানা দরকার। ও হ্যাঁ, ভাল কথা। ইয়াং টাইগারস-এর নাম শুনেছ?’

‘ইদানীং বেশ শোনা যাচ্ছে এদের নাম, স্যর। কতকগুলো বড় লোকের ছেলে।’

‘হা। পূর্ব পাকিস্তানের সব বাঘা বাঘা শিল্পপতিরা মিলে করেছে টাইগারস ক্লাব—আর তাদের বখে যাওয়া অপদার্থ ছেলেরা মিলে ক্লাব গড়েছে ইয়াং টাইগারস। কোটিপতি বাপের টাকার জোরে মদ, জুয়া, মেয়েমানুষ নিয়ে যথেচ্ছাচার করে বেড়াচ্ছে। ওদের কয়েকটা অপকর্মের কথা আমার কানেও এসেছে। খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি টাকার জোরে ফাইল গায়েব। এদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় কয়েকজন নানান অপকৌশলে (ঘুষ, মদ, নারী) ভাল ভাল কিছু ইণ্ডাস্ট্রি বাগিয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যেই। যাক, যশোর থেকে খবর এসেছে কয়েকজন ইয়াং টাইগারস এই মিশনের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। ওদের একজন নর্তকীর উপর নাকি তাদের চোখ। এদের আণ্ডারএস্টিমেট কোরো না। প্রয়োজন হলে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দ্বিধা কোরো না। আমার সমর্থন থাকবে তোমার পেছনে। এখন বলো, তোমার কোনও প্রশ্ন আছে?’

‘না, স্যর।’

কেন জানি রানার মনে হলো কোনও কারণে রাহাত খান ভিতর ভিতর বড় উদ্বিগ্ন এবং বিরক্ত। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না। ব্যক্তিগত প্রশ্ন পছন্দ করেন না রাহাত খান। হয়তো H-এর ধৃষ্টতা এই উদ্বেগের কারণ হবে। রহমানের মৃত্যু হয়ত কুরে কুরে যন্ত্রণা দিচ্ছে ওকে।

প্যাড থেকে একটা কাগজ টান দিয়ে ছিঁড়ে চার ভাজ করে রানার দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি।

‘এতে যা লেখা আছে কাল প্লেনে উঠে তারপর পড়বে। আজ সাতাশে আগস্ট—ওরা আছে যশোরে, কুষ্টিয়ায় থাকবে আটাশ-ঊনত্রিশ, রাজশাহীতে তিরিশ-একত্রিশ, দিনাজপুরে পয়লা-দোসরা। কথাগুলো মনে রেখো। আর কেবল বিপদ নয়, মৃত্যুর জন্যেও প্রস্তুত থেকো। ব্যস, আর কোনও কথা নেই, যেতে পার।’

আস্তে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল মাসুদ রানা কামরা থেকে।