ফুল ফুটিল। অভিরাম স্বামী গড় মান্দারণে গমন করিয়া মহাসমারোহের সহিত দৌহিত্রীকে জগৎসিংহের পাণিগৃহীত্রী করিলেন।

উৎসবাদির জন্য জগৎসিংহ নিজ সহচরবর্গকে জাহানাবাদ হইতে নিমন্ত্রণ করিয়া আনাইয়াছিলেন। তিলোত্তমার পিতৃবন্ধুও অনেকে আহ্বানপ্রাপ্ত হইয়া আনন্দকার্যে আসিয়া আমোদ আহ্লাদ করিলেন।

আয়েষার প্রার্থনামতে জগৎসিংহ তাঁহাকেও সংবাদ করিয়াছিলেন। আয়েষা নিজ কিশোরবয়স্ক সহোদরকে সঙ্গে লইয়া এবং আর আর পৌরবর্গে বেষ্টিত হইয়া আসিয়াছিলেন।

আয়েষা যবনী হইয়াও তিলোত্তমা আর জগৎসিংহের অধিক স্নেহবশতঃ সহচরীবর্গের সহিত দুর্গান্তঃপুরবাসিনী হইলেন। পাঠক মনে করিতে পারেন যে, আয়েষা তাপিতহৃদয়ে বিবাহের উৎসবে উৎসব করিতে পারেন নাই। বস্তুতঃ তাহা নহে। আয়েষা নিজ সহর্ষ চিত্তের প্রফুল্লতায় সকলকেই প্রফুল্ল করিতে লাগিলেন; প্রস্ফুট শারদ সরসীরুহের মন্দান্দোলন স্বরূপ সেই মৃদুমধুর হাসিতে সর্বত্র শ্রীসম্পাদন করিতে লাগিলেন।

বিবাহকার্য নিশীথে সমাপ্ত হইল। আয়েষা তখন সহচরগণ সহিত প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ করিলেন; হাসিয়া বিমলার নিকট বিদায় লইলেন। বিমলা কিছুই জানেন না, হাসিয়া কহিলেন, “নবাবজাদী! আবার আপনার শুভকার্যে আমরা নিমন্ত্রিত হইব।”

বিমলার নিকট হইতে আসিয়া আয়েষা তিলোত্তমাকে ডাকিয়া এক নিভৃত কক্ষে আনিলেন। তিলোত্তমার কর ধারণ করিয়া কহিলেন, “ভগিনি! আমি চলিলাম। কায়মনোবাক্যে আশীর্বাদ করিয়া যাইতেছি, তুমি অক্ষয় সুখে কালযাপন কর।”

তিলোত্তমা কহিলেন, “আবার কত দিনে আপনার সাক্ষাৎ পাইব?”

আয়েষা কহিলেন, “সাক্ষাতের ভরসা কিরূপে করিব?” তিলোত্তমা বিষণ্ণ হইলেন। উভয়ে নীরব হইয়া রহিলেন।

ক্ষণকাল পরে আয়েষা কহিলেন, “সাক্ষাৎ হউক বা না হউক, তুমি আয়েষাকে ভুলিয়া যাইবে না?”

তিলোত্তমা হাসিয়া কহিলেন, “আয়েষাকে ভুলিলে যুবরাজ আমার মুখ দেখিবেন না।”

আয়েষা গাম্ভীর্যসহকারে কহিলেন, “এ কথায় আমি সন্তুষ্ট হইলাম না। তুমি আমার কথা কখন যুবরাজের নিকট তুলিও না। এ কথা অঙ্গীকার কর।”

আয়েষা বুঝিয়াছিলেন যে, জগৎসিংহের জন্য আয়েষা যে এ জন্মের সুখে জলাঞ্জলি দিয়াছেন, এ কথা জগৎসিংহের হৃদয়ে শেলস্বরূপ বিদ্ধ রহিয়াছে। আয়েষার প্রসঙ্গমাত্রও তাঁহার অনুতাপকর হইতে পারে।

তিলোত্তমা অঙ্গীকার করিলেন। আয়েষা কহিলেন, “অথচ বিস্মৃতও হইও না, স্মরণার্থ যে চিহ্ন দিই, তাহা ত্যাগ করিও না।”

এই বলিয়া আয়েষা দাসীকে ডাকিয়া আজ্ঞা দিলেন। আজ্ঞামত দাসী গজদন্তনির্মিত পাত্রমধ্যস্থ রত্নালঙ্কার আনিয়া দিল। আয়েষা দাসীকে বিদায় দিয়া সেই সকল অলঙ্কার স্বহস্তে তিলোত্তমার অঙ্গে পরাইতে লাগিলেন।

তিলোত্তমা ধনাঢ্য ভূস্বামিকন্যা, তথাপি সে অলঙ্কাররাশির অদ্ভুত শিল্পরচনা এবং তন্মধ্যবর্তী বহুমূল্য হীরকাদি রত্নরাজির অসাধারণ তীব্র দীপ্তি দেখিয়া চমৎকৃতা হইলেন। বস্তুতঃ আয়েষা পিতৃদত্ত নিজ অঙ্গভূষণরাশি নষ্ট করিয়া তিলোত্তমার জন্য অন্যজনদুর্লভ এই সকল রত্নভূষা প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। তিলোত্তমা তত্তাবতের গৌরব করিতে লাগিলেন। আয়েষা কহিলেন, “ভগিনি, এ সকলের প্রশংসা করিও না। তুমি আজ যে রত্ন হৃদয়ে ধারণ করিলে, এ সকল তাঁহার চরণরেণুর তুল্য নহে।” এই কথা বলিতে বলিতে আয়েষা কত ক্লেশে যে চক্ষুর জল সংবরণ করিলেন, তিলোত্তমা তাহা কিছুই জানিতে পারিলেন না।

অলঙ্কারসন্নিবেশ সমাধা হইলে, আয়েষা তিলোত্তমার দুইটি হস্ত ধরিয়া তাঁহার মুখপানে চাহিয়া রহিলেন। মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, “এ সরল প্রেমপ্রতিম মুখ দেখিয়া ত বোধ হয়, প্রাণেশ্বর কখন মনঃপীড়া পাইবেন না। যদি বিধাতার অন্যরূপ ইচ্ছা না হইল, তবে তাঁহার চরণে এই ভিক্ষা যে, যেন ইহার দ্বারা তাঁহার চিরসুখ সম্পাদন করেন।”

তিলোত্তমাকে কহিলেন, “তিলোত্তমা! আমি চলিলাম। তোমার স্বামী ব্যস্ত থাকিতে পারেন, তাঁহার নিকট বিদায় লইতে গিয়া কালহরণ করিব না। জগদীশ্বর তোমাদিগকে দীর্ঘায়ুঃ করিবেন। আমি যে রত্নগুলি দিলাম, অঙ্গে পরিও। আর আমার–তোমার সার রত্ন হৃদয়মধ্যে রাখিও।”

“তোমার সার রত্ন” বলিতে আয়েষার কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল। তিলোত্তমা দেখিলেন, আয়েষার নয়নপল্লব জলভারস্তম্ভিত হইয়া কাঁপিতেছে।

তিলোত্তমা সমদুঃখিনীর ন্যায় কহিলেন, “কাঁদিতেছ কেন?” অমনি আয়েষার নয়নবারিস্রোত দরদরিত হইয়া বহিতে লাগিল।

আয়েষা আর তিলার্ধ অপেক্ষা না করিয়া দ্রুতবেগে গৃহত্যাগ করিয়া গিয়া দোলারোহণ করিলেন।

আয়েষা যখন আপন আবাসগৃহে আসিয়া উপনীত হইলেন, তখনও রাত্রি আছে। আয়েষা বেশ ত্যাগ করিয়া, শীতল-পবন-পথ কক্ষবাতায়নে দাঁড়াইলেন। নিজ পরিত্যক্ত বসনাধিক কোমল নীলবর্ণ গগনমণ্ডল মধ্যে লক্ষ লক্ষ তারা জ্বলিতেছে; মৃদুপবনহিল্লোলে অন্ধকারস্থিত বৃক্ষ সকলের পত্র মুখরিত হইতেছে। দুর্গশিরে পেচক মৃদু গম্ভীর নিনাদ করিতেছে। সম্মুখে দুর্গপ্রাকার-মূলে যেখানে আয়েষা দাঁড়াইয়া আছেন, তাহারই নীচে, জলপরিপূর্ণ দুর্গপরিখা নীরবে আকাশপটপ্রতিবিম্ব ধারণ করিয়া রহিয়াছে।

আয়েষা বাতায়নে বসিয়া অনেকক্ষণ চিন্তা করিলেন। অঙ্গুলি হইতে একটি অঙ্গুরীয় উন্মোচন করিলেন। সে অঙ্গুরীয় গরলাধার। একবার মনে মনে করিতেছিলেন, “এই রস পান করিয়া এখনই সকল তৃষা নিবারণ করিতে পারি।” আবার ভাবিতেছিলেন, “এই কাজের জন্য কি বিধাতা আমাকে সংসারে পাঠাইয়াছিলেন? যদি এ যন্ত্রণা সহিতে না পারিলাম, তবে নারী-জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলাম কেন? জগৎসিংহ শুনিয়াই বা কি বলিবেন?”

আবার অঙ্গুরীয় অঙ্গুলিতে পরিলেন। আবার কি ভাবিয়া কি খুলিয়া লইলেন। ভাবিলেন, “এ লোভ সংবরণ করিয়া রমণীর অসাধ্য; প্রলোভনকে দূর করাই ভাল।”এই বলিয়া আয়েষা গরলাধার অঙ্গুরীয় দুর্গপরিখার জলে নিক্ষিপ্ত করিলেন।